‘আইএমএফ হচ্ছে সরকারের ওস্তাদ, তাদের শর্তে বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম’

“পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 03:26 PM
Updated : 31 Jan 2023, 03:26 PM

আইএমএফের শর্ত মেনে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বব্যাংক নামে ওস্তাদ প্রতিষ্ঠান আছে। এমনকি আইএমএফ নামেও আরও একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তারা নানাভাবে সরকারকে দিক-নির্দেশনা দেয় এবং পথ দেখায়।

“আইএমএফ ঋণের সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু শর্তও জুড়ে দিচ্ছে। সেগুলো সরকারের মেনে নিতে কোনো সমস্যা নেই। সেগুলোর মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো, গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উল্লেখযোগ্য।”

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, “তারা বলছে, সামনে আমরা আরও বাড়াতেই থাকবো। তারা বাড়াবো বলে না, ‘সমন্বয়’ শব্দ ব্যবহার করে। এই শব্দটা তারা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে শিখেছে। তারা বলে, আমরা সমন্বয় করবো। এতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এটা তো জনগনের ওপর যাচ্ছে। মজুরি ছাড়া বাকি সব কিছুর দাম বাড়াতে তারা সবসময় চায়।”

মঙ্গলবার সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আয়োজনে অনুষ্ঠিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এক সমাবেশে আলোচক হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন।

আনু মুহাম্মদ বলেন, “আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কিছু কিছু শর্ত দিয়ে থাকে তার মধ্যে দুর্নীতি দূর করতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেগুলো ঠিক করতে হবে সেগুলো নিয়ে তাদের মাথাব্যথা কম এবং সরকারেরও মাথা ব্যথা কম। আর যেগুলো মানলে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বিরক্ত হন এবং সরকারও খুব আগ্রহী।”

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়- মন্তব্য করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “এর অর্থ এই নয় যে, এটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ভিন্ন চিন্তা থাকতে হবে। অনিয়মগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায়, শুধু কনস্ট্রাকশনের কাজই বেশি চলে৷ অথচ ক্লাসরুম, পড়াশোনার গুণগত মান নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও প্রাইভেটেশজন করার চেষ্টা চলছে।”

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আব্দুল মজিদ অন্তরের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব আমান উল্লাহ খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অবিলম্বে শিক্ষার মান উন্নয়নে রাকসু ও সিনেট কার্যকরসহ মোট ১৪ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, “হাতুড়ি মেরে কখনও মেরুদণ্ড ভাঙা যায় না, এটাকে আমি অমানবিকীকরণ বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যদি একজন শিক্ষার্থী কোনো স্বার্থে তার আত্মমর্যাদা হারিয়ে তারই নিজের সহপাঠীকে আঘাত করে তার চেয়ে লজ্জার কিংবা মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয়ের আর কিছু হতে পারে না। একেই বরং আমি মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া বলি।”

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা আসলে কী হওয়া উচিত। এ জায়গায় পুরো বিশ্বকে ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন মানুষের মত, চিন্তার বৈচিত্রকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সেই পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেক হোল্ডার কারা- এটা আগে বুঝতে হবে। কোনো একটি কাঠামো কিংবা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সুযোগ থাকতে হবে৷”

“আমরা অনেকে মনে করি, একটা রাকসু আন্দোলন কিংবা নির্বাচন করে দিলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এতেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না। সাধারণ শিক্ষার্থী বা জনমানুষের নজরদারি দরকার। নইলে স্বচ্ছতা/জবাবদিহিতা সৃষ্টি হবে না। মানুষের প্রতি মানুষের যে সম্মান, দায়বদ্ধতা সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা অনেকটাই সেই চর্চা থেকে দূরে সরে এসেছি, তাই হয়তো আজ এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন জানান, “শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাশক্তি মেরে ফেলা হয়। প্রাইমারি পর্যায়েই ব্যাপক বইয়ের বোঝা নিজেদের কাঁধে বইতে হয়। এর ফলে যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন বড় পরিসরে চিন্তা করতে পারে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও চায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সেই ১৫/২০ বছরের পুরনো শিট, নোট পড়িয়ে তা মুখস্থ করাতে। এর ফলে ভিন্ন কোনো চিন্তা তৈরি হচ্ছে না।”

সভাপতিত্বের বক্তব্যে রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-৭৩ সমুন্নত রাখতে ছাত্র সংসদ ও সিনেট কার্যকর করা অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘদিন যাবত এই কার্যক্রম অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের মুক্ত আলোচনা ও ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে।”

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আর রাজী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল ইসলাম মাসউদ।

সমাবেশ থেকে অবিলম্বে রাকসু ও সিনেট কার্যকরের পাশাপাশি আবাসন সংকট নিরসনে মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দের ব্যবস্থা, হলে রাজনৈতিক ব্লকের নামে দখলদারিত্ব নিষিদ্ধ, হলে ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খাবারের পুষ্টিগুণ নিশ্চিতকরণ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সপ্তাহে সাত দিন সার্বক্ষণিক খোলা রাখা, যাতায়াতের জন্য রুট বৃদ্ধিসহ পর্যাপ্তসংখ্যক বাস সংযুক্ত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের অবস্থান ও উন্নত মানের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রাখা, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি, পূর্ণাঙ্গ টিএসসিসি নির্মাণ করা, বেনামে আদায়কৃত অযৌক্তিক ফি বাতিল করা, জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সান্ধ্য আইন ও সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করা, পরীক্ষার উত্তরপত্রে রোল নম্বরের পরিবর্তে মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো কোড সিস্টেম চালু করা, পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিও তোলা হয়।