যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ২০ নারীর আবেদন এসেছে; যার অধিকাংশই চা বাগানের বলে জানান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ইউএনও।
Published : 12 Dec 2023, 07:48 PM
৫২ বছর পরেও সেই রাতের কথা মনে হলে কেঁপে উঠেন রেনু রানী। তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে, কোনো কথা বলতে পারেন না। যেন কানে বাজে সেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ। যে রাতে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছিলেন সারাজীবনের মত।
সত্তরোর্ধ্ব রেনু রানী দে এখন জীবনের শেষবেলায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। দারিদ্র্য আর অসহায় অবস্থার মধ্যেই তার জীবন কাটছে মৌলভীবাজারের কালীঘাট চা বাগানে। একাত্তরে সভ্রম হারানো এই নারী এখনও রয়ে গেছেন সরকারের তালিকার বাইরে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের এক সকালে কালীঘাট চা বাগানের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে এবং নির্যাতিত নারী রেনু রানীসহ অন্যদের খোঁজে আমরা গিয়েছিলাম সেই চা বাগানে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে রেনু রানীর আবাস খোঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। অনেক নারীই জড়ো হয়েছেন সেখানে। জানালেন, সবাই শ্রমিক কলোনিতেই থাকেন।
সকালের মিষ্টি রোদে রেনু রানী একটি চেয়ারে বসে ছিলেন। তার পাশেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন ছমরু আর কয়েকজন বৃদ্ধ নারী। কিন্তু রেনু রানী কোনোভাবেই সেই রাতের কথা শুরু করতে পারছিলেন না।
তিনি মাথা নীচু করে চেয়ারে নির্বাক বসেছিলেন। তখন চারপাশে এক অদ্ভুত নিরবতা নেমে আসে। কয়েক মিনিট পর রেনু রানী যখন মুখ তোলেন তখন তার চোখ গড়িয়ে জল পড়ছিল। পাশের আরেক নারী এসে তার হাত ধরেন; সাহস জোগান। তাকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেনু রানী সেই রাতের কাহিনি বলতে শুরু করেন।
রেনু রানীর বাংলা সনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া ধারণা অনুযায়ী, তখন জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস হবে। স্বামী সুধীর রঞ্জন দে বাগানেই ছোটখাট কাপড়ের ব্যবসা করেন। ফ্যাক্টরি লাইনে একটি কুঁড়েঘরে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে তাদের আর্থিক টানাপোড়েনের সংসার।
যুদ্ধের বাজারে ব্যবসা কমে সেই অনটন তখন আরও বেড়েছে। তাদের সঙ্গে থাকতেন রেনুর মা ও মাসি। মেয়েটা বড়, তার তখন পাঁচ বছর আর ছোট ছেলের আড়াই। রেনু তখন আবার সন্তানসম্ভবা।
কিছুদিন আগে বাগানে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানিরা বাগানে আসার পর অনেকেই যে যার মত করে কলোনি ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ পাশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পরিবার নিয়ে ভারতে গিয়ে শরণার্থী হয়েছেন। কেউ কেউ দূরের চা বাগানে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
কিন্তু সুধীর রঞ্জন ও রেনু রানীর পরিবার যেতে পারেনি। কারণ, হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। এই অবস্থায় কোথায় যাবেন, কী খাবেন? তারচেয়ে বাগানে থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন তারা। এর মধ্যেই মাঝে মাঝে শ্রমিকরা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন, হত্যার নানা খবর নিয়ে আসে। কালীঘাট চা বাগানের শ্রমিকদের জোর করে কারখানায় কাজ করানো হয়। শ্রমিক চলে যাওয়ায় অনেক সময় আশপাশ থেকে মানুষদের ধরে এনে কারখানা চালানো হত।
এসব দেখে-শুনে ভয়ে আতকে উঠেন সুধীর রঞ্জন। কিন্তু কোথাও যাওয়ার উপায় তো নেই। ভয়ে ভয়েই দিনরাত কাটত তাদের। খুব বেশি একটা বাড়ি থেকে বেরও হতেন না।
এই আতঙ্কের মধ্যেই রাতে স্বামী-সন্তান নিয়ে শুয়েছিলেন রেনু রানী। একই ঘরে ছিলেন মা ও মাসি। হঠাৎ দরজার প্রচণ্ড শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারেন পাকিস্তানি সেনারা হানা দিয়েছে। প্রতিরোধ করার কিছু ছিল না। সামান্য একটা দরজা সেনারা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। ঘরের অন্ধকার কেটে গেছে টর্চ লাইটের আলোতে। আর সেনাদের বুটের আওয়াজে কেটে গেছে রাতের নিস্তব্ধতা।
রেনু রানী তখন বিছানাতেই বসে ছিলেন। তার স্বামী সুধীর রঞ্জনকে কয়েক সেনা ধরে বাইরে বের করে নিয়ে যায়। মা, মাসি আর সন্তানদের বন্দুকের নলের মুখে ভয় দেখিয়ে ঘরের এক কোণে বসিয়ে রাখে।
রেনুর বিছানার কাছে তিনজন সেনা আসে। একজন হাতে ধরে রাখে আর দুইজন তাকে নির্যাতন করে। পরে তারা তাকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে বের করে এবং বাগানের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানতে থাকে। রেনু রানী বুদ্ধি করে শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন। অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভেবে রেনুকে ফেলে রেখে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে চলে যায় পাকিস্তানি সেনারা।
পরদিন রেনু পরিবার নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান দুর্গা লাইনে। উদ্দেশ্য যে করেই হোক ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু স্বামীকে যে ধরে নিয়ে গেছে; তাকে ছাড়া কীভাবে যাবেন? স্বামীর অপেক্ষায় বাগানেই থেকে যান রেনু, ভারতে আর যাওয়া হয়নি।
ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে চারদিকে মানুষের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। নিখোঁজ অনেক মানুষ বাড়ি ফিরে আসেন। রেনুর গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। কিন্তু দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও রেনুর স্বামী আর ফিরে আসেননি। তিন সন্তান, মা আর মাসিকে নিয়ে রেনু অথৈ সাগরে পড়ে যান। কিন্তু হাল ছাড়েননি। অব্যক্ত বেদনা আর কষ্টের মধ্যেই তিনি তিন সন্তানকে বড় করেছেন।
রেনুর আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৫২ বছর সাত বছর পরেও তিনি জানতে পারলেন না তার স্বামীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্ভ্রম হারানো নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। অনেকের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। তারা সরকারি ভাতাও পাচ্ছেন। কিন্তু বাগানে পড়ে থাকা রেনু রানী তা জানতেন না। কেউ তাকে কোনোদিন এ বিষয়ে বলেওনি।
সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছমুরু নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে তাকে বলেন এবং তার আবেদনটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। সেটি এখন যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, কালীঘাট চা বাগান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে। শহীদ হয়েছেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ আলী।
যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় কালীঘাট চা বাগানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। ধীর ধীরে সেটি শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠে। এখান থেকে তারা আশপাশের এলাকায়ও অভিযান চালাত। নারী নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট করাই ছিল তাদের কাজ।
মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকবার কালীঘাট চা বাগান হানাদারমুক্ত করতে আক্রমণ করে; কিন্তু ব্যর্থ হয়। অগাস্টে মাঝামাঝি ভারতের কমলপুর ক্যাম্পে ট্রেনিংপ্রাপ্ত প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সেখানে চতুর্থবারের মতো আক্রমণ করে। তখন তারা বাগানের কারখানাটি উড়িয়ে দেয়। তখন ৮ থেকে ১০ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ১৫-১৬ রাজাকারকেও আটক করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা কালীঘাট চা বাগানের ক্যাম্প ছেড়ে যায়নি। পরে তারা আশপাশের চা বাগান থেকে আরও সেনা এনে এখানে জড়ো করে।
মুক্তিযোদ্ধা ও কালীঘাট চা বাগানের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেসময় রেনু রানীর মত অনেককেই পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন করে। এতদিন লোকলজ্জার ভয়ে কেউ এসব কথা বলতেন না। কিন্তু এখন অনেকেই মুখ খোলতে শুরু করেছেন।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সুধীর রঞ্জন দের স্ত্রী রেনু রানী দে, ভক্ত তাঁতীর স্ত্রী বুল তাঁতী, নাথো তাঁতীর মেয়ে সাবি তাঁতী, সরগীয়া তাঁতীর স্ত্রী হেমলা তাঁতী, কুশ তাঁতীর মেয়ে শরশতি তাঁতী, দশরত কালোয়ারের মেয়ে লাখো কালোয়ার, নিধনী তাঁতীর মেয়ে তরু তাঁতী ও লতা তাঁতী, মরতি তাঁতীর মেয়ে অঞ্জনা তাঁতী, অর্জুন তাঁতীর মেয়ে অঞ্জনা তাঁতী, নেফুল তাঁতীর মেয়ে পার্বতী তাঁতী ও আর্থ তাঁতীর মেয়ে দুলালী তাঁতী।
নির্যাতনের শিকার বুলু তাঁতীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই বলেন, “যুদ্ধ শেষ হল সেই কবে, আর আজকে আমাদের কথা জানতে আসছেন!”
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এই প্রথম কেউ তাদের খোঁজ নিতে এল বলেও উল্লেখ করে বুলু তাঁতী।
কালীঘাট চা বাগানের ৯ নম্বর লাইনের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব জয়বল দোষাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেনু রানীর ঘটনাটি ছিল খুবই মর্মান্তিক। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে তাকে নির্যাতন করা হয়। স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তার স্বামী ফিরে আসেননি। স্বামীর ফিরে আসার আশায় তিনি এই বাগানেই পড়ে থাকেন। খুব কষ্ট করে তিনি পরবর্তীতে জীবন পরিচালনা করেন।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন ছমরু বলেন, “শ্রীমঙ্গল উপজেলায় শতাধিক নারীর ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। বিষয়টি গ্রামের মানুষের জানা। অনেকেই লোক-লজ্জার ভয়ে বলেননি। এখন বয়স হয়েছে তাই কেউ কেউ মুখ খুলছেন।
“সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কালীঘাট ও তার আশপাশের চা বাগানের নারীরা। সে সময় তারা অনেকেই লুকিয়ে থাকতেন। কিন্তু ছাগল ছড়াতে গিয়ে অনেক নারী ধরা পড়তেন পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের হাতে। কেউ কেউ মারাও গেছেন। আমাদের এই লাল সবুজের বাংলার ইতিহাসের এক একটি অংশই হচ্ছেন এই বীর-মাতারা”, যোগ করেন মোয়াজ্জেম হোসেন ছমরু।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন কমান্ডার কুমুদ রঞ্জন দেব বলেন, “কালীঘাট চা বাগানে অনেক নারী নির্যাতন হয়েছেন সেটা তিনি শুনেছেন। সরকার এখন বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিচ্ছে। আমরা খোঁজ করে সঠিক তথ্য নিয়ে তাদের আবেদন করতে সহায়তা করছি।”
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, “যাচাই-বাছাইয়ে জন্য এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ২০ জন নারীর আবেদন এসেছে। যার অধিকাংশই চা বাগানের। টিম তৈরি করে তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেছি।”