অভিভাবকদের নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে ইউনিসেফ সাঁতার শেখা প্রকল্প গুটিয়ে নিয়েছে বলেও জানান এনজিও কর্মকর্তা।
Published : 15 Apr 2024, 09:48 PM
বরিশালে ৭২ ঘণ্টায় আটজনের ‘প্রাণহানি’ হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে; বাকি চারজন এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাঁতার না জানা, অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং নদী ও স্রোত সম্পর্কে ধারণা না থাকাই এসব অপমৃত্যুর কারণ।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, শনিবার বেলা ১১টা থেকে সোমবার বেলা সাড়ে ১২টার মধ্যে বরিশালের বানারীপাড়া, মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জের নদী ও খালে ডুবে এসব ‘প্রাণহানি’র ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে এক তরুণী ও তিন শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার বিকাল পর্যন্ত দুই শিশুসহ চারজন নিখোঁজ রয়েছে।
পানিতে ডুবে মৃত বা নিখোঁজদের মধ্যে পাঁচজন ঈদে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
যাদের লাশ পাওয়া গেছে তারা হলো- সিলেটের বাসিন্দা সৌদি আরব প্রবাসী মো. সোহেল রানার কন্যা শান্তা ইসলাম (১৮), হিজলা উপজেলার মেমানিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চর দূর্গাপুর গ্রামের জেলে আক্তার হাওলাদারের ছেলে জাকারিয়া (৪), বোরহান (৬) এবং গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের জেলে জসিম মাতুব্বরের চার বছর বয়সী কন্যা মিম।
নিখোঁজ রয়েছে- মুলাদী উপজেলার গলইভাঙা গ্রামের মো. মাহমুদ হাসানের মেয়ে হাবিবা হাসান অর্পা (১৭) এবং একই বাড়ির মো. বাবুর মেয়ে হিজরাতুল মুনতাহা হাফসা (১৩), হিজলা উপজেলার বরজালিয়া ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন মোল্লার ছেলে ইয়ামিন মোল্লা (১১) এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন দক্ষিণ চর এককরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ঢাকায় ফ্যান তৈরির ফ্যাক্টরির শ্রমিক মনির খানের ছেলে রায়হান খান (১১)।
হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রাকিব সিকদার জানান, সোমবার সকাল ১০টার দিকে নদীতে মাছ ধরতে নামেন বেদে সদস্য বাবা-মা। নৌকায় ছিল তাদের শিশুকন্যা মিম।
একসময় বাবা-মায়ের নজর এড়িয়ে মিম নদীতে পড়ে যায়। পরে অপর এক জেলের জালে তার লাশ পাওয়া যায়। জেলা প্রশাসকের অনুমতিতে লাশ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
হিজলা ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, সোমবার বেলা সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে ইয়ামিন মোল্লা অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মেঘনা নদীতে গোসল করতে যায়। সাঁতার না জানার কারণে স্রোতে তলিয়ে গেছে ইয়ামিন। সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চালিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
শিশু ইয়ামিন ঈদে বাড়িতে বেড়াতে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। সাঁতার না জানার পর শিশুকে নদীতে গোসল করতে যেতে নিষেধ না করার জন্য অভিভাবকদের দুষছেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
বানারীপাড়া ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার আনোয়ার হোসেন বলেন, শনিবার সকালে শান্তা উপজেলার মরিচবুনিয়া গ্রামে মামীর বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে। মহাখালী টিঅ্যান্ডটি মহিলা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শান্তা তার ছোট বোন লামিয়াকে নিয়ে ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ির সামনে বেলুয়া নদীতে গোসল করতে যায়।
এ সময় পা পিছলে নদীতে পড়ে যায় সে। সাঁতার না জানায় স্রোতে ভেসে গিয়ে ডুবে যায়। রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে ২০০ ফুট দূরে শান্তার লাশ ভেসে উঠে। পরে ঢাকায় নিয়ে দাফন করা হয়েছে।
রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মেঘনা নদীর শাখা খালে দাদার সঙ্গে গোসল করতে যায় হিজলা উপজেলার চর দূর্গাপুর গ্রামের জেলে আক্তার হাওলাদারের ছেলে জাকারিয়া ও বোরহান।
উপজেলার মেমানিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নোমান সরদার জানান, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে দাদা সেরাজ হাওলাদারের সঙ্গে চর দূর্গাপুর খালে যায়। দুই নাতিকে খাল পাড়ে রেখে দাদা সেরাজ হাওলাদার গোসল করতে নামেন।
সাঁতরে গোসল শেষে ফিরে আর দুই নাতিকে দেখতে পাননি সেরাজ। এরপর খালে তল্লাশি শুরু করেন। দুপুর ১টার দিকে দুই নাতিকে খাল থেকে ডুবন্ত উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তখন চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
একই দিন মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ চর এককরিয়া গ্রামে গজারিয়া নদীতে পড়ে নিখোঁজ হয় ঢাকার একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রায়হান।
হিজলা ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, রায়হান ঈদে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। রোববার বেলা ১১টার দিকে বাড়ির আরেকটি শিশুর সঙ্গে গ্রামের রহমানের হাট খেয়াঘাট এলাকায় যায়। তখন রায়হান নদীতে পড়ে যায়।
রায়হানের সঙ্গে থাকা শিশুটি তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে সেও হাবুডুবু খায়। তখন স্থানীয় এক ব্যক্তি বিষয়টি দেখতে পেয়ে ওই শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারলেও রায়হান নিখোঁজ হয়। সোমবার বিকাল পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মুলাদী ফায়ার স্টেশনের লিডার মো. নূরুল ইসলাম জানান, ঈদে বেড়াতে এসে বাবা মাহমুদ হাসানের সঙ্গে আড়িয়াল খাঁ নদীতে গোসল করতে যায় অর্পারা দুই বোন। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের চাচাত দুই বোন।
গলইভাঙা ঢালী বাড়ি লঞ্চঘাট এলাকায় গোসলে নেমে সাঁতার না জানায় চার কন্যা ডুবে যায়। তখন মাহমুদ হাসান দুইজনকে টেনে তুলতে পারেন। তবে নিজের কন্যা অর্পা ও ভাইয়ের কন্যা হাফসা নিখোঁজ হয়।
ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার নুরুল ইসলাম বলেন, সোমবার বিকাল পর্যন্ত তাদের সন্ধান করা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায়নি।
যেসব কারণে মৃত্যু
ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার নুরুল ইসলাম মনে করেন, মানুষের অসচেতনতার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। নদীর গভীরতা ও স্রোত সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই।
সাঁতার না জেনে নদীতে নেমে ডুবে গিয়ে মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে সচেতন করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার।
ইউনিসেফের একটি প্রকল্পের আওতায় বরিশাল নগরীর শিশুদের সাঁতার শেখাত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) স্কোপ।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, অন্যান্য শিক্ষার সঙ্গে শিশুর জীবন রক্ষার জন্য সাঁতার শেখানো জরুরি। কিন্তু অভিভাবকদের সেই বিষয়ে কোনো নজর নেই। উৎসবে এসে তারা গোসল করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
তিনি বলেন, “বিদেশে শিশুদের তিন বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো শিশুকে সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুদের কাছে জানতে চাইলেই বিষয়টি জানা যাবে।
“কিন্তু শিশুদের সাঁতার শেখায় বেশ আগ্রহ রয়েছে। যখন সাঁতার শেখানো কার্যক্রম ছিল তখন অনেক শিশু স্কুল পালিয়ে এসে সাঁতার শিখেছে। এ নিয়ে অভিভাবকদের রোষানলেও পড়তে হয়েছে।”
অভিভাবকদের নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে ইউনিসেফ সাঁতার শেখানো প্রকল্পটি গুটিয়ে নিয়েছে বলেও জানান এনায়েত হোসেন শিবলু।
আরও পড়ুন: