মামলাতেও থামছে না মহাসড়কের মাঝে যাত্রী নামানো

নিয়ম অনুযায়ী ঢাকাগামী যানবাহন কাঁচপুর সেতু দিয়ে নামার সময় সার্ভিস লেনে ঢুকে শিমরাইল বাস-স্টপেজে যাত্রী নামানোর কথা।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2024, 05:50 AM
Updated : 20 March 2024, 05:50 AM

হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা বাড়লেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝখানে বাসের যাত্রী নামানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে যাত্রীদেরও মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে উঁচু সড়ক বিভাজক লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে। 

হাইওয়ে পুলিশ বলছে, মামলা দিয়েও মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। বাসচালকসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা তৈরি না হলে এই প্রক্রিয়া থামানো কঠিন। 

অপরদিকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি, অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে সার্ভিস লেনে যানজট লেগে থাকে, তা থেকে বাঁচতেই তাদের এভাবে যাত্রী নামাতে হচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে দ্রুতগামী যানবাহনের লেনে টাকার বিনিময়ে মই দিয়ে উঁচু সড়ক বিভাজক পারাপারের একটি ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় হাইওয়ে পুলিশ রবিউল হোসেন নামের এক তরুণকে দুটি মইসহ আটকও করে। 

তারপরই মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানো বন্ধে হাইওয়ে পুলিশের বিশেষ তৎপরতা চালাতে দেখা যায়।  

শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. শরফুদ্দিন জানান, রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত নির্ধারিত স্থানে যাত্রী না নামিয়ে মহাসড়কের মাঝখানে নামানোয় ৭৮টি বাসের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।

বুধবার সকাল থেকেও পুলিশের কার্যক্রম চলছে বলে জানান তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, আট লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চারটি লেন দ্রুতগামী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। এই চার লেনের সঙ্গে দুই পাশে দু’টি করে সার্ভিস লেন রয়েছে। মাঝখানে উঁচু সড়ক বিভাজক দিয়ে লেনগুলোকে আলাদা করে দেওয়া। সড়কের ওপরে ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও সংগত কারণেই মহাসড়কের মাঝখান থেকে তাতে ওঠার সুযোগ নেই।

নিয়ম অনুযায়ী ঢাকাগামী যানবাহন কাঁচপুর সেতু দিয়ে নামার সময় সার্ভিস লেনে ঢুকে শিমরাইল বাস-স্টপেজে যাত্রী নামানোর কথা কিন্তু বাসচালকরা তা না করে দ্রুতগামী লেনে যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছেন। 

মঙ্গলবার দুপুরে দেড় ঘণ্টায় অন্তত ১৭টি দূরপাল্লার বাসের যাত্রীদের নির্ধারিত বাস-স্টপেজে না নামিয়ে মহাসড়কের মাঝখানের দ্রুতগামী লেনে নামাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাসের বিরুদ্ধে হাইওয়ে পুলিশকে মামলা করতেও দেখা গেছে। 

একপর্যায়ে এমনও দেখা গেছে, হাইওয়ে পুলিশ যখন দু’টি বাসের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর কার্যক্রমে ব্যস্ত ঠিক তখন তাদের অদূরেই যাত্রীদের মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দিচ্ছে অন্য দু’টি বাস। 

এ সময় বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে উঁচু সড়ক বিভাজক পার হতে দেখা গেছে নারী, পুরুষ ও শিশুদের।

এর মধ্যে মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দেওয়ায় শিশু কন্যা সন্তানকে নিয়ে সমস্যায় পড়ে যান তাসলিমা বেগম। আঁখি এক্সক্লুসিভ নামে বাসের স্টাফদের সঙ্গে তর্কেও জড়াতে দেখা যায় এই নারীকে। পরে পুলিশ এসে ওই বাসটির বিরুদ্ধেও মামলা দেয়। 

তাসলিমা বলেন, “এই জায়গায় নামিয়ে দিছে বাসের লোকজন। পুরুষ মানুষ তারপরও লাফাইয়া যাইতেছে। এইখান দিয়া আমি এই বাচ্চা নিয়ে কীভাবে পার হবো বলেন তো দেখি?” 

রবিন আহমেদ নামে আরেক যাত্রী বলেন, “বাসের চালক ইচ্ছা করে মহাসড়কের মাঝখানে নামিয়ে দেয়। ডিভাইডার দিয়ে লাফিয়ে পার হতে গিয়ে কে কখন গাড়ির নিচে পড়ে তার কোনো চিন্তা নেই ওদের। পুলিশের সামনেই এই কাজ করে তারা।” 

উঁচু সড়ক বিভাজক পার হতে না পেরে অন্তত সাত নারীকে মহাসড়কের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে একটু ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে পার হন তারা।

তিন বছর বয়সী শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মহাসড়কের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় সাজু আহমেদকে। তিনি বলেন, “মাঝখানে বাস থামিয়ে নামিয়ে দিয়েছে। বাচ্চা নিয়া তো উঁচু ডিভাইডার পার হতে পারবো না। 

“সামনে নাকি সড়কের এক জায়গায় কাটা আছে ওইখান দিয়ে রাস্তা পার হবো। এইভাবে বিজি একটা হাইওয়ের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়াটাও তো রিস্কি। এইগুলো থামাবে কে?” 

তবে অন্তত তিনটি বাসের চালক ও স্টাফদের সঙ্গে কথা হলে তারা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেন। তাদের অভিযোগ, সার্ভিস লেনের অর্ধেকই বিভিন্ন যানবাহনের অবৈধ পার্কিং থাকে। তারা সড়ক দখল করে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠান। এতে সার্ভিস লেন দিয়ে বাস প্রবেশ করালে যানজটে পড়তে হয়। 

তবে অনেক সময় যাত্রীরাও তাদের দেখানো মতো জায়গায় নামতে চান বলেও অভিযোগ করেন পরিবহনগুলির কর্মীরা।

মঙ্গলবার দুপুরে মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানোয় শ্যামলী এনআর ট্রাভেলস নামে পরিবহনের একটি বাসের বিরুদ্ধে মামলা দেয় পুলিশ। 

চট্টগ্রাম থেকে আসা বাসটির সুপারভাইজার আবির হোসেন বলেন, “সার্ভিস লেনে সারাক্ষণ জ্যাম করে রাখে। যাত্রীরাও স্টপেজ থেকে একটু দূরে গিয়ে নামতে চান না। রাস্তা ক্লিয়ার থাকলে তো আমাদের যাত্রী নামাতে অসুবিধা নাই।” 

সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দ্রুতগামী (ভিআইপি) ও সার্ভিস লেনের মাঝের সড়ক বিভাজকটি আগে আরও নীচু ছিল। শিমরাইল মোড়ে একটি পকেট গেটও ছিল। 

তবে মহাসড়কের মাঝখানে যাত্রী নামানো বন্ধ করতে এক বছর আগে সড়ক বিভাজকটি উঁচু করা হয়েছে। তিন মাস আগে পকেট গেটটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এই স্থান থেকে কাছাকাছি পকেট গেটও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। 

শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের এসআই নূর মিয়া বলেন, “এইখানে মূলত দুইটা লেন আছে; একটা ভিআইপি লেন, আরেকটা সার্ভিস লেন। বাসগুলোর যাত্রীদের সার্ভিস লেনে এসে যাত্রী নামানোর কথা কিন্তু বাসচালকেরা তাদের সুবিধার্থে ভিআইপি লেনেই যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। এতে ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরা।

সার্ভিস লেনে অবৈধ পার্কিংয়ের অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশের তৎপরতায় সার্ভিস লেনে অবৈধ পার্কিংয়ের সুযোগ এখন নেই। বাসের যাত্রীদের ওঠা-নামায় কিছুটা সময় তো লাগেই। কিন্তু দূরপাল্লার চালকরা সে সময়টা দিতেও রাজি না।” 

তিনি আরও বলেন, “মহাসড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা কাজ করছি। এইরকম ঘটনা পেলেই বাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু করছি।” 

শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. শরফুদ্দিন বলেন, “শিমরাইল মোড়ে আমাদের দুইজন পুলিশ নিয়মিত থাকে। তারপরও একটি মোবাইল টিম গত কয়েকদিন ধরে পার্মানেন্টভাবে রেখেছি, বাসগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। 

“কিন্তু কোনোভাবেই এই কার্যক্রম থামানো যাচ্ছে না। বাসচালক, সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্টরা যদি সচেতন না হয় তাহলে তো মামলা দিয়ে এইসব থামানো কষ্টকর।”