ভঙ্গুর পথটিকে এখন সড়ক বলে চেনাই দায়। তবুও এখানকার লেবু, আনারসসহ অন্যান্য ফসলাদি পরিবহনের একমাত্র রাস্তা এটি।
Published : 20 Aug 2023, 09:37 AM
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ডুলুছড়া এলাকার বালিশিরা পাহাড় ব্লকের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া যেন যুদ্ধ জয় করা।
কখনও লাফ দিয়ে, কখনও জঙ্গল মাড়িয়ে, কোথাও গাছের চাড়ে ভাঙন পেরিয়ে, আবার কোথাও পাহাড়ি ছড়ার পানিপথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী এই শিশুদের।
আর বৃষ্টিতে ছড়ায় ঢল নামলে সেদিন স্কুল কামাই করা ছাড়া গতান্তর নেই ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীদের।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডুলুছড়া এলাকার পাহাড় ব্লকের একমাত্র সড়কটির বেহাল দশাতেই এমন চড়াই-উৎরাই পার হতে শিক্ষার্থীদের। শুধু শিক্ষার্থী নয়; ভোগান্তি পোহাতে হয় সম্প্রতি চালু হওয়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর বাসিন্দাসহ স্থানীয়দেরও।
এই সড়কের পাশ্ববর্তী গ্রামের মানুষকেও কষ্ট করে এ পথ দিয়ে যেতে হয় শহরে বা তাদের জুমে। ওই ভঙ্গুর পথটিকে এখন সড়ক বলে চেনাই দায়। তবুও এখানকার লেবু, আনারসসহ অন্যান্য ফসলাদি পরিবহনের একমাত্র রাস্তা এটি।
আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর ১১৩টি বাড়ির সন্তানদেরও ভর্তি হতে হবে ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সম্প্রতি সরজমিনে দেখা যায়, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে একদল শিশু ওই রাস্তা দিয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে রাস্তাটির তিন জায়গায় ভাঙা। এর একটিতে গাছের টুকরা দিয়ে এপার-ওপাড় সংযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
সড়কের ওই ভাঙার মুখে দাঁড়িয়ে আছে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী মণি আক্তার। সঙ্গের ছেলেরা হাতল ছাড়া ওই গাছ দিয়ে পার হয়ে গেলেও মণি ভয়ে পার হতে পারছে না। পরে ইয়াছিন, রুহিন ও হাসিবুল আবার অপর প্রান্তে গিয়ে মণিকে ধরে ধরে গাছ দিয়ে এই ভাঙ্গাটি পার করে।
এ সময় সাংবাদিক দেখে ছুটে আসেন ওই গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা। তিনি বলেন, “এই রাস্তা এখানে কী দেখছেন- একটু কষ্ট করে সামনের অবস্থাটা দেখে আসুন।”
তার এমন অনুরোধে কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকও পথ ধরে স্কুলের। কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল এ রকম আরও একটি ভাঙন। সেখানেও গ্রামবাসী এমন বিকল্প ব্যবস্থা করেছেন। এর পর ছড়ার পাশ দিয়ে সরু সড়ক দিয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আর যাওয়ার উপায় থাকে না।
তখন বাধ্য হয়ে নেমে যেতে হয় পাহাড়ি ছড়ায়। পরে ছড়ার পানি মাড়িয়ে প্রায় দেড়শ গজ অতিক্রম করে আবার ডাঙ্গায় উঠতে হয়। ডাঙ্গায় হাঁটার সেই পথও সরু। দু’পাশ ঘন জঙ্গলে আবৃত। পাশেই ডুলছড়া ত্রিপুরা পল্লির শ্মশান। পথের কোথাও কোথাও ঘাসে-আগাছায় রাস্তাও দেখা যায় না।
এরই মধ্যে পেছনে আসা মাসুদ মিয়ার পায়ে কামড় বসিয়েছে দুটি জোঁক। এই রাস্তা দিয়ে সামনে এগোতে ভয় ভয় লাগছিল। অথচ এ পথ পাড়ি দিয়েই ছোট ছোট শিশুরা স্কুলে যায়।
তাদের সঙ্গী হয়েই ডলুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত যাই। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন স্কুলে পৌঁছায় তাদের মনে সে কি আনন্দ!
সড়কের এমন বেহাল দশা নিয়ে কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অর্জুন দত্তের সঙ্গে।
তিনি জানান, তাদের বিদ্যালয়ের বেশিরভাগই পাহাড়ি জনবসতির শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিদ্যালয়ের তিন দিকের রাস্তা ভালো থাকলেও ডুলুছড়ার যে অংশে মুসলিম বসতি রয়েছে (পাহাড় ব্লক) সে পাশের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসতে খুবই কষ্ট হয়।
পশ্চিম পাশের রাস্তা হলে তার বিদ্যালয়ে উপস্থিতি আরও বাড়বে বলে জানান এ শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাহিন মিয়া জানায়, প্রতিদিনই তাদের এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয়। প্রায় সময় পড়ে গিয়ে কাপড় ও বইপত্র ভিজে যায়।
তৃতীয় শ্রেণির ইয়াছিন জানায়, স্কুলে আসার পর ‘ছড়ার গোলা’ (বৃষ্টিতে ছড়ায় ঢল) এলে অটোরিকশায় করে লাউয়াছড়া রাস্তায় ঘুরে বাড়ি ফিরতে হয়।
গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, শুধু এই রাস্তার কারণে বাচ্চাদের এখন স্কুলে দিতে ভয় হয়। এই পাহাড়ি জনবসতির সন্তানদের স্কুলগামী করতে হলে এই রাস্তাটি সংস্কার ও পাকা করা জরুরি।
তিনি জানান, মাঝে-মধ্যেই এই রাস্তার দু’পাশে আগাছানাশক স্প্রে করেন। কিন্তু কিছুদিন মরা থাকলেও তা আবার হয়ে রাস্তা ঢেকে যায়।
এ ব্যাপারে স্থানীয় লেবু বাগানের মালিক শ্যামল দাশ জানান, রাস্তা ভাঙা থাকায় তার বাগানের লেবু-আনারস শহরে পাঠানো খুবই কষ্টকর। এখন ‘ডাবল খরচ’ বহন করতে হয়।
এজন্য চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে জানান এই কৃষক।
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া রুনা বেগম জানান, তার স্বামী রিকশা চালান। এখন রাস্তা যদি ভালো না হয় তাহলে তো তার স্বামী রিকশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘরে আসতে পারবেন না।
একই কথা জানান আশ্রয়ণে ঠাঁই পাওয়া সালমা বেগম। তিনি বলেন, “আমাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তা নেই। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে যেতে হলেও রাস্তা ভাঙা।”
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, এখানে আশ্রয়ণের ১১৩টি ঘর দেওয়া হয়েছে। বর্ষায় এই রাস্তাটির কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত এই রাস্তাটি করে দেওয়া হবে। এর মধ্যেই প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সন্দ্বীপ তালুকদার বলেন, এখানে কালভার্টসহ আরসিসি ঢালাই দিয়ে রাস্তা হবে। সেভাবেই প্রস্তাব করা হয়েছে।