হাওরে অন্ধকার তাড়ানোর উদ্যোগ এখন তাদেরই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার মানুষের অভিযোগ, সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বিক্রির দুই প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি ফাউন্ডেশন ও আরএসএফের মামলায় তারা হয়রানিতে পড়েছেন; অকারণে জেলেও খেটেছেন।

বাপ্পা মৈত্রশামস শামীমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2023, 07:46 PM
Updated : 7 Nov 2023, 07:46 PM

দূর গ্রামের এসব বাসিন্দাদের কেউ বাড়িতে আলো জ্বালাতে সৌর প্যানেলই কেনেননি, কেউবা কিস্তির টাকা পরিশোধও করেছেন; তবুও মামলায় নাম এসেছে, জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। বিনা অপরাধের তাদের কেউ কেউ জেলও খেটেছেন।

জরিমানা দিয়ে কারাবাস শেষে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বেরিয়ে আসার পর সৌর প্যানেল বিক্রয়কারী একটি কোম্পানি আবার তাদের কাছে ‘ভুল স্বীকার’ করেছে; জরিমানার টাকা ‘ফেরতও দিয়েছে’।

সম্প্রতি এমন ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি একজনের সঙ্গে অন্যজনের নামের মিল থাকাতেও জেলে যেতে হয়েছে সুনামগঞ্জের শাল্লার কয়েক গ্রামের বাসিন্দাদের।

হাওরের বাড়িগুলোতে অন্ধকার দূর করতে কিস্তিতে সৌর প্যানেল বিক্রি করতে গিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের এমন ‘ভুল’ এখন অনেক মানুষের বিপদ আর হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা শাল্লা উপজেলায় একসময় সৌর প্যানেল বিক্রি করা গ্রামীণ শক্তি ফাউন্ডেশন ও রহিম আফরোজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রুরাল সার্ভিসেস ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও বিনা অপরাধে জেল খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানির এমন অভিযোগ উঠেছে।

 এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাতেও তুলেছেন জনপ্রতিনিধিরা।

সরজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শাল্লার ডুমরা, আনন্দপুরসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েকশ মানুষের বিরুদ্ধে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল কেনার পর কিস্তি পরিশোধ না করা এবং হুমকি-ধামকি দেওয়ার অভিযোগে মামলা করে কোম্পানি দুটি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্যানেল কেনেননি কিংবা কিস্তি পরিশোধ করেছেন এমন অনেকের বিরুদ্ধেও মামলা করেছে কোম্পানি দুটি। সেই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে জেলে ভরছে। আদালতে জরিমানা দিয়ে তারা মুক্ত হচ্ছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কোম্পানি দুটি ও তাদের আইনজীবী বলছেন, ‘কোথাও ভুল থাকলে ঠিক করা হবে’। তবে বিনা কারণে জেল খেটে আসা মানুষের হয়রানির দায়ভারের কী হবে তা নিয়ে তারা নিশ্চুপ।

কোম্পানি দুটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৪১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও ভুক্তভোগীদের দাবি, এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যকের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আল-আমিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুটি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানি এলাকার সাধারণ মানুষজনকে হয়রানি করছে। এ বিষয়ে তাদেরকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রকৃত গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করতে।”

দ্রুত এ কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা ও জেলা প্রশাসনের সভায় তুলেছি। তারপরও কোনো প্রতিকার মিলছে না। এলাকার বহু মানুষকে তারা আসামি করেছে। নিরপরাধ মানুষজন জেল খাটছেন ও জরিমানা গুণছেন।”

শাল্লা থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকটি মামলায় এখন পর্যন্ত ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাহকের নামে ওয়ারেন্ট এসেছে; আরও আসবে। আমার মনে হয়, মামলার আসামি আরও অনেকে হতে পারেন। কারণ দুটি কোম্পানি একসঙ্গে মামলা করেছে।’’

এতে সাধারণ মানুষ হয়রানিতে পড়ছে কি না- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এলে সেই অনুযায়ী আসামি গ্রেপ্তারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

তবে নিরপরাধ ও ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে অভিযোগ করতে পারেন বলে জানান তিনি।

নিরপরাধদের হয়রানির বিষয়টি শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু তালেব শুনেছেন। এটি নিয়ে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনার কথাও জানান তিনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন হয়রানির বন্ধ চান তিনিও।

তিনি বলেন, “বহু আগে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে শাল্লার অনেক হতদরিদ্র মানুষ এখন আইনি নোটিস ও মামলার ওয়ারেন্ট পেয়ে মানসিকভাবে অস্বস্তিতে আছেন। অনেক নিরপরাধ মানুষও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

“আমাকে কেউ লিখিতভাবে বিষয়টি না জানালেও মৌখিকভাবে অনেকে জানিয়েছেন। এ বিষয়টি উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও উত্থাপিত হয়েছে।”

এসব বিষয়ে জানতে গত ২৫ অক্টোবর বিকালে সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে আরএসএফ ও গ্রামীণ শক্তির কার্যালয়ে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। দুই কক্ষের একটি বাসাতেই এ দুই কোম্পানির কার্যালয়। সামনে কলাপসিবল গেইটের সঙ্গে সাইনবোর্ড ঝোলানো।

সেখানে থাকা নম্বরে যোগাযোগ করলে আরএসএফ এর কর্মকর্তা আকবর হোসেন কথা বলতে চাননি।

এ বিষয়ে রহিম আফরোজের সহযোগী এ প্রতিষ্ঠানের ঢাকা কার্যালয়ের সিনিয়র ম্যানেজার চৌধুরী আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, “যারা আমাদের কাছ থেকে সৌর প্যানেল নিয়ে টাকা পরিশোধ করেননি এমন চার হাজার ৫০০ জনকে আমরা আইনি নোটিস দিয়েছি। এর মধ্যে দুই হাজার ৫০০ জনের মতো লোক পাওনা টাকা জমা দিয়েছেন।

“প্রায় ৩০০ জনের বিরুদ্ধে আমরা মামলা দিয়েছি। কিছু ওয়ারেন্টও ইস্যু হয়েছে। তবে আমরা যা করছি আইনি প্রক্রিয়ায় করছি; কাউকে হয়রানি করছি না।”

গ্রামীণ শক্তি ফাউন্ডেশনের হেড অব এডমিন মাহবুবুল ইসলাম পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের বিপত্তি হওয়ার কথা নয়। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেওনি। তারপরও আমরা খোঁজখবর নিয়ে কোনো ভুল-ত্রুটি পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”

যে কারণে মামলা

হাওর অঞ্চল হওয়ায় শাল্লার দুর্গম অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বা পল্লী বিদ্যুৎ যাওয়ার আগে এ দুটি কোম্পানি সৌরবিদ্যুতেরে আলোয় অন্ধকার দূর করতে সৌর প্যানেল বিক্রি শুরু করে। শাখা কার্যালয় খুলে তারা কিস্তিতেও প্যানেল বিক্রি করে। তখন অনেক গ্রামবাসী সৌর প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুতের দেখা পান। এদের অধিকাংশই গ্রামীণ শক্তি ও রহিমআফরোজ বাংলাদেশ লিমিটেডের সহযোগী কোম্পানি আরএসএসের কাছ থেকে প্যানেল কেনেন।

উভয় প্রতিষ্ঠানই ২০০৬ সাল থেকে শাল্লায় বিক্রয়কেন্দ্র খুলে সৌর প্যানেল (সোলার হোম সিস্টেম) বিক্রি করছে। প্যানেলের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে দামের রকমফের হয়। প্যানেল নেওয়ার সময় এককালীন কিছু অর্থ পরিশোধ করতে হয়। বাকি টাকা গ্রাহকরা দুই থেকে তিন বছরের কিস্তিতে পরিশোধ করেন।

প্রত্যন্ত এলাকার হাজারো মানুষ প্যানেল কিনে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে বাড়িঘর আলোকিত করেছেন। কোম্পানি কোনো জামানত বা জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াই এসব প্যানেল বিক্রি করেছে।

গ্রামীণ শক্তির শাল্লা শাখার ব্যবস্থাপকের সই করা গ্রাহকদের দেওয়া ‘কিস্তি পরিশোধের বই’ এ দেখা যায়, সেখানে গ্রাহকের নম্বর, নাম, সিস্টেমের ক্ষমতা, ঠিকানার পাশাপাশি মোবাইল নম্বর রয়েছে।

তবে সেই কিস্তি পরিশোধ করতে না পারার কারণেই গ্রাহকদের বিরুদ্ধে কোম্পানি দুটি সুনামগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করতে শুরু করে। গ্রামীণ শক্তি মোট ১১৫ জনের বিরুদ্ধে এবং আরএসএফ ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলেছে।

মামলার অভিযোগে গ্রামীণ শক্তি বলেছে, আসামিদের কিস্তির টাকা পরিশোধের জন্য বার বার তাগাদা দেওয়া হলেও তাতে সাড়া দেননি। দেই-দিচ্ছি করে তারা টাকা দেননি। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের সভায় ডাকা হলে আসেননি। উপরন্তু ফোন করা হলে তারা অশালীন ভাষায় কোম্পানি প্রতিনিধিকে গালিগালাজ করেছেন।

“গত ২৬ জুন আবার তাদের ডাকা হয়। সেদিন অনেকেই আসেন। কিন্তু কোম্পানির প্রতিনিধিকে নানাভাবে হুমকি দেন এবং টাকা দিতে অস্বীকার করেন। সবাই মিলে এক হয়ে শলা-পরামর্শ করে এই কাজ করেছেন,” বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

গ্রাহক ‘মন্তু সরকার’, জেল খাটলেন ‘মন্টু সরকার’

 

গ্রামীণ শক্তির মামলায় জেল খেটে জরিমানা দিয়ে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন ডুমরা গ্রামের মন্টু সরকার। তাকে পুলিশ ৪ অক্টোবর রাতে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। পরের দিন আদালতে গিয়ে দেখেন যে মামলা হয়েছে সেখানে তার বাবার নাম লেখা হয়েছে নদী সরকার। অথচ যে পরোয়ানায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেখানে বাবার নাম লেখা হয়েছে নরেন্দ্র সরকার।

মন্টু সরকারের দাবি, “গ্রামীণ শক্তি কী আমি জানিই না। কোনো কোম্পানির কাছ থেকে কখনও কোনো সৌরবিদ্যুৎও নেই নাই। অথচ ৪ অক্টোবর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আমাকে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, পরে দেখা যায়, আসলে এই পরোয়ানা হওয়ার কথা ছিল মন্তু সরকারের নামে। তখন মন্তু সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কিস্তির ১৫ হাজার টাকা আগেই পরিশোধ করেছেন।

মন্তু সরকারের পরিবর্তে কোম্পানির পক্ষ থেকে মন্টু সরকারকে আইনি নোটিস দেওয়া হয়; পরে সে অনুযায়ী মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় বলে তথ্যে দেখা গেছে।

বিনা দোষে কারাবাস খেটে আসা মন্টু সরকার আক্ষেপ করে বলেন, “মাঝপথে আমি হয়রানির শিকার হলাম, আমার টাকাও খরচ হয়েছে। এমনভাবে চলতে পারে না; তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা দরকার।”

এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন শাল্লা সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আনন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা তরুণ কান্তি দাশের ভাতিজা।

তরুণ কান্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, এলাকার লোকজন বলছে দুটি কোম্পানি ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। তারা কারও কাছে চার হাজার, ছয় হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার পর্যন্ত টাকা বকেয়া পায়।

“এজন্য অনেকের নামে ওয়ারেন্ট এসেছে। কোম্পানি দুটি গ্রাহকের নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে না জেনে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করছে।

তার ভাষ্য, “কয়েকদিন আগে অন্য একজনের নামের সঙ্গে শুরুর নামের মিল থাকায় আমার ভাতিজা কৃপেন্দ্র চন্দ্র দাশকে (৪০) পুলিশ ধরে নেয়। পরে সে আদালতে ছয় হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পায়।

“তারপর কোম্পানির লোকজনকে ধরলে তারা বলেন, এটা ভুলে হয়েছে। তখন লোকজনের চাপে তার সেই টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এভাবেই হয়রনি করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, ওই দুই কোম্পানির সঙ্গে স্থানীয় একটি চক্র জড়িত হয়ে এসব কাজ করছে।”

এ ব্যাপারে মামলার বাদী ও গ্রামীণ শক্তির শাখা ব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “এটি ভুলে হয়েছিল।”

 

প্যানেল না কিনেও তারা আসামি

ডুমরা গ্রামের মৃত কৃষ্ণ কান্ত দাশের ছেলে কৃপেন্দ্র চন্দ্র দাশ (৪০) দুই দশকের বেশি সময় ধরে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন। ৮ অক্টোবর গভীর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হয়। কৃপেন্দ্রর বাবার নাম মৃত কৃষ্ণ কান্ত দাশ হলেও মামলায় লেখা হয়েছে ‘প্রতিকী চন্দ্র দাশ’। পরিবারের সদস্যরা কাকুতি-মিনতি করলেও পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আসে।

পরদিন সুনামগঞ্জ আদালতে তাকে চালান দেওয়া হয়। তিনি গ্রামীণ শক্তির দায়ের করা মামলায় ছয় হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করে মুক্তি পান।

কৃপেন্দ্র বলেন, “আমি গ্রামীণ শক্তির নামই শুনি নাই। গরিব মানুষ কোনোদিন সৌরবিদ্যুৎও আনি নাই। আমার নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমার মোট ১২ হাজার টাকা খরচ হইছে। মান-সম্মানও গেছে। আমি এর বিচার চাই।

“পরে কোম্পানির ভুল হওয়ায় গ্রামীণ শক্তির উকিল রাধাকান্ত সূত্রধর বাবু আমাকে ছয় হাজার টাকা দিয়ে বলেছেন ভুল হয়ে গেছে।“

ক্ষুব্ধ এ ব্যক্তি বলেন, “আমার টাকা-পয়সা নাই; নাইলে আমারে হয়রানি করার প্রতিবাদে আমি তারার বিরুদ্ধে মামলা করতাম।”

একই গ্রামের সুবল চন্দ্র দাশের ছেলে সুজন চন্দ্র দাশও একই রকম অভিযোগ করেন। তাকে পুলিশ ৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে সুনামগঞ্জ পাঠায়। পরে গ্রামীণ শক্তির কিস্তির চার হাজার টাকা পরিশোধ করে তিনি মুক্তি পান।

তার অভিযোগ, “আমি সৌরবিদ্যুতের কিছুই জানি না। গ্রামীণ শক্তির কাছ থেকে সৌরবিদ্যুৎ আমি ক্রয়ও করিনি। তবু আমার নামে মামলা হয়েছে। ওই কোম্পানি নামে-বেনামে ঢালাওভাবে নিরপরাধ মানুষকে মামলায় আসামি করেছে।”

তিনি বলেন, “আমার সব মিলিয়ে প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। জামিন নিয়ে এসে খোঁজ নিলাম রৌয়া গ্রামের সুবীর চন্দ্র দাসের ছেলে সুজন চন্দ্র দাস আমাদের গ্রামে অবিনাশ বাবুর বাসায় ভাড়া থাকত। সে নিয়েছিল।

“এখন তার বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে উকিল সাব (গ্রামীণ শক্তির আইনজীবী রাধাকান্তু সূত্রধর) বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তারও কোনও খবর নাই।’’

 

কিস্তি শোধ; তবুও পরোয়ানা থেকে নাম সরেনি

শাল্লার আনন্দপুর গ্রামের বিকাশ চক্রবর্তীর অভিযোগ, আরএসএফের কিস্তি পরিশোধের পরও তার নাম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে সরানো হয়নি।

তিনি বলেন, “অনেকেরই কিস্তি পরিশোধের ডকুমেন্ট থাকার পরও তাদের নামে ওয়ারেন্ট হয়েছে। হবিবপুর আনন্দপুর গ্রামের অনেকই বিদ্যুৎ নেননি তাদের নামেও মামলা হয়েছে।

“কোম্পানির মাঠকর্মীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা জমা না দেওয়ায় আমরা এই পেরেশানিতে পড়েছি।”

শাল্লা উপজেলার গুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারের ব্যবসায়ী আশীষ রায় বলেন, “অনেক আগে ৩২ হাজার টাকায় একটি সৌর প্যানেল নিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ কিস্তি পরিশোধ করার পর তারা আমাকে গিফট দিয়েছিল একটি ছাতা। এখন আমার নামে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে ৮ হাজার টাকা বকেয়ার।

“আমার মত অনেকের কিস্তির টাকা নিয়ে তারা রেজিস্ট্রারে তোলেননি। অসচেতন যারা তাদের পাশ বইয়ে তোলেনি। এখন আইনি নোটিস ও ওয়ারেন্ট পেয়ে সবাই হতাশ”, বলেন তিনি।  

এ বিষয়ে দিরাই ও শাল্লায় আরএসএফের দায়িত্বে থাকা আকবর হোসেন বলেন, “যাদের নামে ওয়ারেন্ট রয়েছে তারা কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে রি-কল থানায় দিলেই মামলা শেষ। আমরা একসঙ্গে কয়েকজনের নামে মামলা করেছি, তারা সবাই টাকা দিয়ে দিলে কোম্পানি মামলা তুলে নেবে।”

দুই কোম্পানির বক্তব্য

গ্রামীণ শক্তির পক্ষে মামলার বাদী রিকভারি অফিসার আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাতটি মামলায় ১১৫ জন আসামি রয়েছেন। প্রায় ৭০০ জন গ্রাহকের কাছে আমাদের কোম্পানি টাকা পাবে। আইডি কার্ড ছাড়াই সৌরবিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দিরাই আর সুনামগঞ্জে আমাদের অফিস আছে। আগে আমাদের শাল্লা শাখায় তিনটি অফিস ছিল; বর্তমানে কোনো অফিস নাই।”

২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কোম্পানি সেখানে প্যানেল বিক্রি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নিরপরাধ মানুষের হয়রানির বিষয়ে একটা সমাধান হবে।”

এ সময় তিনি জানান, আরেকটি কোম্পানিও আছে। তাদের মামলাতেও আসামি অনেক হবেন।

আরএসএফ এর দিরাই ও শাল্লার দায়িত্বে থাকা আকবর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শাল্লায় তাদের ১ হাজার ১৬৭ জন গ্রাহক রয়েছেন। পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য গ্রাহকদের আগে লিগ্যাল নোটিসও দেওয়া হয়। তারপর যারা টাকা দেননি বা যোগাযোগ করেননি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

৩০০ গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে জানিয়ে তার দাবি, তারা গ্রাহক ছাড়া কাউকে হয়রানি করছেন না।

জনপ্রতিনিধি ও আইনজীবীরা যা বলছেন

উপজেলায় সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির মামলায় অনেক মানুষ আছেন যারা সৌরবিদ্যুৎ নেননি বা চিনেন না তাদেরকেও গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছেন শাল্লা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টুও।

তিনি বলেন, “বহু মানুষকে আসামি করে ওয়ারেন্ট ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেকে জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে মুক্তি পেয়েছেন।”

তার অভিযোগ, “আমার মনে হচ্ছে একটি সিন্ডিকেট এটি করছে; এ বিষয়ে আমি উপজেলা সমন্বয় সভায় কথা বলেছি। বন্যার সময় অনেক গ্রাহকের কিস্তি পরিশোধের রশিদ হারিয়ে গেছে, তাদেরও নতুন করে টাকা দিতে হচ্ছে। না হয় মামলার আসামি করা হচ্ছে। এই হয়রানিমূলক কাজ দ্রুত বন্ধ করার দাবি জানাই।”  

দুটি কোম্পানিরই আইনজীবী রাধাকান্ত সূত্রধর বলেন, “নামের প্রিন্টিং ভুলের কারণে আরেকজনের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। আমার প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে এই ভুল সংশোধন করে নিয়েছে।”

তিনি বলেন, “এ ছাড়া এ বিষয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনার পর মামলা বা ওয়ারেন্টের বদলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতায় বকেয়া কিস্তি আদায়ের জন্য বলা হয়েছে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফয়সাল আতিক]