আনোয়ারুজ্জামান দাবি করেছেন, ‘উচ্চপর্যায় থেকে’ তাকে নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করতে বলা হয়েছে।
Published : 07 Feb 2023, 08:41 PM
এ বছরের মাঝামাঝি সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে; কিন্তু তার আগে এই শীতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নিয়ে ‘তৎপরতায়’ উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে নগরীতে।
গত ২২ জানুয়ারি হঠাৎ করেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেট নগরে প্রচার শুরু করেন। তিনি ও তার সমর্থকরা দাবি করতে থাকেন, দলের হাই কমান্ডের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েই তারা প্রচারে নেমেছেন।
তারপর থেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাদের ভাষ্য, আনোয়ারুজ্জামান `বিলাত থেকে উড়ে এসে সিলেটে জুড়ে বসেছেন’।
আনোয়ারুজ্জামান বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসন (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) থেকে মনোনয়নের চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে তিনি বিফল হন। এর আগে তিনি কোনোদিন সিটি নির্বাচনে আলোচনায় আসেননি, প্রচারও চালাননি।
আগামী জুন-জুলাইয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সিটির আয়তন আগের চেয়ে বেড়েছে; ২৭টি থেকে ৪২টি ওয়ার্ডে উন্নীত হয়েছে নগরী।
২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত চারবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিগত প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০২০ সালের ১৫ জুন মারা যান।
২০০৩ সালে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী কামরান ২০০৮ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও কারাগার থেকে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল থেকে মেয়র পদে আছেন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী।
আরিফুল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। ফলে এবার আরিফুলের বিএনপি থেকে প্রার্থী হওয়া নিয়ে দ্বিধা আছে। দলীয়ভাবে তিনি নির্বাচনে না গেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন কি না, এ নিয়ে আলোচনা আছে নগরীতে।
বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুর পর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল, সিসিক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ শিপলু।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করেন। তার আগে গত ২২ জানুয়ারি তিনি লন্ডন থেকে সিলেট এম এ জি ওসমানী বিমানবন্দরে এলে হাজারো নেতাকর্মী তাকে স্বাগত জানান। বিরাট গাড়িবহরে তাকে নগরীতে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে পুরো নগরে জোরালো প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।
এসব নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চাঞ্চল্য বিরাজ করছে। এই অবস্থার মধ্যেই সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলকে নিয়ে নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাদাটিকর এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণ করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এ সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, “স্মার্ট সিলেট সিটি গড়তে আনোয়ারুজ্জমান চৌধুরী কাজ করে যাচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা তার সঙ্গে আছি। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার কাণ্ডারী হয়ে এই সিটিকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরে আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাবো।“
এ সময় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার সিলেটের প্রতি আন্তরিক। সিলেটবাসীর জন্য সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীতকরণসহ নানা উন্নয়ন করা হয়েছে। আগামীতে আমি সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হলে সিলেট সিটিকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করব।”
এর একদিন বাদে মঙ্গলবার ‘বিভ্রান্তি না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়ে’ বিবৃতি দিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগ।
কমিটির সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বিবৃতিতে বলেন, “গতকাল (৬ ফেব্রুয়ারি) সিটি করপোরেশনের কোনো একটি ওয়ার্ডে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট সিটি মেয়র নির্বাচনের মনোনয়ন প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা মহানগর আওয়ামী লীগের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
“এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আমরা পাইনি।
“অতএব ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগরের শৃঙ্খলাসহ দলীয় ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট না হয় এবং বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ানো হয় সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ বিষয়ে আহ্বান জানানো যাচ্ছে।”
এ বিষয়ে জানার জন্য মঙ্গলবার রাতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলকে মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘উচ্চপর্যায় থেকে’ তাকে সিলেট সিটির নির্বাচনকে সামনে রেখে কাজ করতে বলা হয়েছে। তাই তিনি কাজ করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেট নগরের সঙ্গে আমার সর্ম্পক দীর্ঘদিনের। আমি সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের নির্বাচনে কাজ করেছি; পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচনেও কাজ করেছি। সাবেক মেয়র কামরানের সিটি নির্বাচনেও সিলেট নগরীতে দলের জন্য কাজ করেছি। দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হতে পারলে এই শহরকে ডিজিটাল ও আদর্শ শহরে পরিণত করতে কাজ করব।”
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল বলেন, “দলীয় মনোনয়নের কোনো নির্দেশনা এখনও আমার পাইনি। গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সিলেটে এসেছিলেন; তিনিও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি আমাদের। আমাদের নেত্রী আছেন, তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। জনগণের পাশে ছিলাম; আগামীতেও থাকব। মনোনয়নের বিষয়ে অনেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।”
মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিটি নির্বাচনের জন্য মাঠে রয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিয়েছেন। গত নির্বাচনের আগে তিনি প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তিনি আশাবাদী।
“তবে দল যাকে প্রার্থী করবে, তার পক্ষেই আমরা সবাই কাজ করব।”
বিকালে মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলীয় মনোনয়নের কোনো নির্দেশনা এখনও পাইনি। এই প্রক্রিয়া যা সম্পন্ন হয়নি। আমরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। দল যাকে প্রার্থী করবে, তার পক্ষেই আমরা সবাই কাজ করব। তবে আমি আশাবাদী দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে।”
মনোনয়ন প্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, সিলেট- ২ আসন ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গত দুটি সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে দেশে ফিরে মেয়র পদে নির্বাচন করতে ‘দলীয় উচ্চপর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন বলে প্রচার করছেন।
“এটি আমাদের কাছে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতই মনে হচ্ছে। এ নিয়ে সিলেট আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতা ক্ষুব্ধ। উনি যদি নির্বাচন করেন তাহলে আমরা যারা এতদিন ধরে মাঠে আছি তাদের কী হবে?”
এদিকে, আগামী সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীর প্রার্থিতা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে। আর বিএনপির সিদ্ধান্ত মানলে, নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হতে পারবেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ নির্বাচন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে। আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না।”