জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় দীর্ঘ সময়েও কাজ শুরু করতে না পারায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করবে না বলে দিয়েছে।
Published : 14 Apr 2023, 09:21 AM
জমি অধিগ্রহণ কাজ না এগোনোয় শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৯ সালে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়। চার বছরে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হলেও জমি অধিগ্রহণ হয়েছে অতি সামান্য।
এ কারণে দীর্ঘ সময়েও কাজ শুরু করতে না পারায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এতে এ সড়কের মাধ্যমে দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বলছে, জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসনের ধীরগতির কারণে কাজটি এগোচ্ছে না।
কিন্তু শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের দাবি, নিয়ম মেনেই জমি অধিগ্রহণের কাজ এগোচ্ছে।
শরীতপুর জেলা সড়ক ও জনপথ (সওজ) কার্যালয় থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগের জন্য ২০০১ সালে শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কটি চালু হয়। ভেদরগঞ্জ উপজেলার মেঘনার নরসিংহপুর ফেরিঘাট থেকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার মনোহর বাজার পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য ৩১ কিলোমিটার।
সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ২০১৯ সালের ১২ মার্চ একনেকে ৮৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বছরের জুনেই জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন। সড়কের জন্য ২২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করার কাজ শুরু হয়।
এ কাজের জন্য সওজের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে ৪৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চার বছর গেলেও এখনও পুরো জমি বুঝে পায়নি সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
মোট ১৯টি এলএ [জমি অধিগ্রহণ] কেইসের মাধ্যমে এ অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার তধ্যে তিনটি এলএ কেইসের চেক প্রদানের নোটিশ দেওয়া হয়েছে, যার পরিমাণ মাত্র সাড়ে ৪ কিলোমিটার অংশের ৪২ দশমিক ৫৫ একর জমি। সওজ শুধু এই পরিমাণ জমিই বুঝে পেয়েছে। বাকি সাড়ে ২৬ কিলোমিটার সড়কের ১৮৪ দশমিক ৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনও চলমান।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কটির মধ্যে ৭টি কালভার্ট প্রশস্ত করা হবে এবং ১৭টি নতুন কালভার্ট নির্মাণ করা হবে।
এ জন্য চারটি গুচ্ছ প্রকল্পে চারটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয় সওজ। প্রকল্প শেষ করার জন্য প্রথম দফায় মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ে কোনো কাজ না হওয়ায় মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করবে না বলে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে।
নরসিংহপুর ফেরিঘাট থেকে চরসেন্সাস মাদবরকান্দি পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার সড়কের কাজ পেয়েছে মীর হাবিবুল আলম অ্যান্ড রানা বিল্ডার্স। প্রতিষ্ঠানটি দুই কিলোমিটার অংশ পর্যন্ত ইটের খোয়া দিয়ে বালু ভরাট করেছে। আর দুটি কালভার্ট নির্মাণ করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে না।
এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মিলন শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০২০ সালের ২৫ মার্চ কার্যাদেশ পাই। এরপর লোকজন নিয়ে প্রকল্প এলাকায় আসি। তিন বছর ধরে বসে আছি। এখনও জমি বুঝে পাইনি। কাজ করতে গেলে মানুষ বাধা দেয়।”
প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে ফেঁসে গেছেন দাবি করে তিনি বলেন, “এখন আবার নির্মাণ সামগ্রীর দাম ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। প্রকল্পের ব্যয় না বাড়ালে আমরা কাজ করতে পারব না।”
চরসেন্সাস মাদবরকান্দি থেকে মনোহর বাজার পর্যন্ত প্রথম ১৭ দশমিক ১ কিলোমিটারের কাজ যৌথভাবে পেয়েছে ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স ও মাইনুদ্দিন বাশি লিমিটেড নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৮ কিলোমিটারের কাজ যৌথভাবে পেয়েছে বদরুল ইকবাল, হাসান টেকনো বিল্ডার্স ও ওয়েস্টার্ন ট্রাভেশন অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
২০২১ সালের ফেরুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল; ১৮ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখনও জমিই বুঝে পায়নি তারা। গত বছরের অক্টোবরে ওই প্রকল্পে কাজ না করার কথা জানিয়ে সওজকে চিঠি দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক ঘুরে ও স্থানীয় আবুল হোসেন মাল, মিজানুর রহমান ঢালীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো ৩১ কিলোমিটার সড়কই খানাখন্দে ভরা। সড়কজুড়ে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে বিভিন্ন যানবাহন।
খুলনা থেকে চট্টগ্রামগামী দিদার পরিবহনের চালক রাশেদুজ্জামান বলেন, শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক দিয়ে গেলে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ কম হয়। তাই ২০ বছর ধরে সড়কটি দিয়ে বাস চালাচ্ছেন। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা ও গর্ত থাকায় অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
ট্রাকচালক রবিন শেখ, হাবিব খান, মনির মোল্লা বলেন, শরীয়তপুর-চাদপুর সড়কটি দিয়ে বেনাপোল, ভোমরা, পায়রা, খুলনা ও মোংলা বন্দরের পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পরিবহন করা হয়। শরীয়তপুর অংশে এলেই চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। বেহাল সড়কের কারণে এক ঘণ্টার পথ যেতে হয় ২ থেকে ৩ ঘণ্টায়।
ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্সের মালিক শফিকুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কার্যাদেশ পাওয়ার পর ১৮ মাস অপেক্ষা করেছি; কিন্তু তারা আমাদের জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এর মধ্যে নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক গুণ বেড়ে গেছে। কত দিনে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবে, সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই বাধ্য হয়ে কাজ না করার কথা সওজকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি।”
শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ভূঁইয়া রেদওয়ানুর রহমান বলেন, জমি অধিগ্রহণে ধীরগতির জন্য সড়কটির কাজ এগোচ্ছে না। ২৫ কিলোমিটার অংশের কাজ করবে না বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানিয়ে দিয়েছে। আর একটি অংশের কাজ চলছে ধীরগতিতে। তারাও বলেছে, প্রকল্প ব্যয় না বাড়ালে কাজ করবে না।
“ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণেই চার লেন সড়কটির নির্মাণ কাজে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ সকল কাজে আবার দরপত্র আহবান করা লাগবে।”
শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ম তান্ত্রিকভাবে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৯টি এল এ কেইস এর মধ্যে ৩টির চেক হস্তান্তরের চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৫টির কাজ এখনও চলছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগকে কিছু অংশ জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সেই অংশের কাজও করছে না।
“অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গণপূর্ত বিভাগ, এসি (ল্যান্ড) অফিসসহ নানা অফিস হয়ে আমাদের কাছে ফাইল আসে, যার কারণে ফাইল দেরি হয়,” বলেন তিনি।