‘স্থবির’ নাকুগাঁও স্থলবন্দর, ‘আশ্বাসেই’ ৮ বছর পার

কোভিড মহামারীকালে বন্ধ হয়ে যায় লোক চলাচলও।

মো. আব্দুর রহিম বাদলশেরপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2023, 02:50 AM
Updated : 24 April 2023, 02:50 AM

অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও স্থলবন্দর চালু হলেও কার্যত অর্থনৈতিকভাবে কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি; শুধু আশ্বাসই সার হয়েছে।

বরং কার্যক্রম চালুর আট বছরের মাথায় এসে ভারত-ভুটান থেকে ১৯টি পণ্য আমদানির অনুমতি থাকলেও আসছে একমাত্র পণ্য পাথর। কয়লা আমদানি শুরু হলেও সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড মহামারীকালে বন্ধ হয়ে যায় লোক চলাচলও।

কিছু অবকাঠামো তৈরি করা হলেও এতদিনে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যের একটি অংশ এবং পাশের ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশে করা এই বন্দর।    

এ অবস্থায় বন্দরের ব্যবসায়ীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। শ্রমিকরা কাজ হারানোর আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। আর স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আশা, খুব শিগগির এখানে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।  

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এলসি করেও পণ্য আমদানি করতে না পারায় লোকসান গুনতে হচ্ছে দিনের পর দিন। এতে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে।

ফলে পাশ্ববর্তী গাবরাকুড়া স্থলবন্দর, কড়ইতলা স্থলবন্দর ও কামালপুর স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয়রা জানান, দূরত্ব কম হওয়ায় পাকিস্তান আমলে এ বন্দর দিয়ে ভারতেও মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি অঞ্চলে লোক চলাচল করত। কিন্তু পরে বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন দশক পর আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়।  

শেরপুর-২ (নালিতাবাড়ী-নকলা) আসনের সংসদ সদস্য ও সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ১৯৯৭ সালে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁওয়ে শুল্ক বন্দরের কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছর পর ২০০২ সালে এক প্রজ্ঞাপনে পাথর ও কয়লা ছাড়া সব ধরনের পণ্যের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ২০০৯ সালে তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে চালুর ঘোষণা দেন।

প্রায় সাড়ে ১৩ একর জমির ওপর ১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় অবকাঠামো। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে নাকুগাঁও থেকে নকলা উপজেলা পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়কের কাজ করা হয় ।দীর্ঘদিন কাজ শেষে ২০১৫ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব পরিচালনায় শুরু হয় কার্যক্রম।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, এই বন্দর দিয়ে আমদানিযোগ্য পণ্যগুলো হলো- পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, বল ক্লে, কোয়ার্টাজ, চায়না ক্লে, গবাদি পশু, কাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, বৃক্ষ, বীজ, গম, মরিচ, রসুন ও আদা।

নাকুগাঁও স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক (ট্রাফিক) পার্থ ঘোষ বলেন, “তালিকাভুক্ত পণ্যের মধ্যে নিয়মিতভাবে পাথর আমদানি করা হচ্ছে। আগে কয়লাও আমদানি করা হতো। বিভিন্ন কারণে বাকি পণ্য আমদানি বন্ধ আছে।

“তবে আমরা আশাবাদী, দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যান্য পণ্য আমদানি ও রপ্তানি বাড়াতে পারব।”

এ স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ২৫০ জন। এর মধ্যে ভারত থেকে পাথর আমদানি করেন দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী।

নাকুগাঁও আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বলেন, “আমরা বারবার তাগাদা দিয়েছি অন্যান্য পণ্য আনার জন্য কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। সহজে আমদানিযোগ্য পণ্যেরও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

“বিশেষ করে, বন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে আসামের জাগির রোডে এশিয়ার সর্ববৃহৎ শুঁটকির বাজার। দেশে চাহিদা থাকার পরও সেখান থেকে শুঁটকি আমদানি করা যাচ্ছে না।“

তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে বারবার আবেদন করার পর সম্প্রতি শুটকি ও সুপারি আমদানির অনুমতি মিলেছে। কিন্তু ভারতীয় শুল্ক বিভাগের আপত্তির কারণে ওই দুইটি পণ্য আনা সম্ভব হচ্ছে না।

“দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান না হলে আমরা পথে বসে যাব। শ্রমিকদের কষ্টের সীমা থাকবে না। তাদের রোজগার বন্ধের কারণে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।”

ব্যবসায়ীরা জানান, ইমিগ্রেশান বন্ধ থাকায় লোকজন চলাচল করতে পারছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা প্রয়োজন থাকলেও যেতে পারছে না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, যে মানের পাথর আমদানি হওয়ার কথা তার চেয়ে নিম্নমানের পাথর আসছে। কিন্তু এর সমাধান করতে হলে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে আগে চিকিৎসার জন্য গোহাটি হয়েও চেন্নাই যেত। তারা এখন যেতে পারছে না।

যোগাযোগ বাড়লে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন তেমনি সরকারি রাজস্বও বাড়বে।

বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, নাকুগাঁও বন্দর শ্রমিক ইউনিয়ন এর অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০০। এ ছাড়া দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে আরও প্রায় এক হাজার শ্রমিক। লোড-আনলোড শ্রমিক ইউনিয়ন, আমদানি রপ্তানিকারক সমিতি ছাড়াও শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে।

নাকুগাঁও স্থলবন্দর লোড-আনলোড শ্রমিক ইউনিয়ন-৪০৪৬ এর একজন শ্রমিক বলেন, এখানকার শ্রমিকদের মধ্যে যারা ইউনিয়নভুক্ত তাদের মজুরি বেশি। তারা দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা মজুরি পান। কিন্তু দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক শ্রমিকের মজুরি তুলনামূলক কম। নারী শ্রমিকদের বেতন আরও কম।

আরেকজন শ্রমিক জানান, যদি এই বন্দর দিয়ে যে ১৯টি পণ্য আসার কথা সবগুলো আসত তাহলে আরও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। এখন শুধু পাথর আসে। ফলে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যাও কম। তিনি বন্দরকে আরও কার্যকর করার আহ্বান জানান।

বন্দরে অনেক নারী শ্রমিককে ক্রাশিং মেশিনে পাথর ভাঙা, নেটিং ও উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কাজ করে তারা ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা মজুরি পান।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ-ভুটানের ভৌগলিক অবস্থান কাছাকাছি থাকলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগুচ্ছে না ভারতের ট্রানজিট সমস্যার কারণে। ভুটানও চাইছে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করতে।

দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি এগিয়ে নেওয়ার জন্য চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি নাকুগাও স্থলবন্দর পরিদর্শন করেন ভূটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুইন্ডসিল।

এ সময় ভুটানের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দরসহ ময়মনসিংহের গোবরাকূড়া ও কড়ইতলী স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্য নিতে চুক্তি করেছে ভুটান।

“ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বৈরিতা নেই। শুধু ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি অনুমোদন হলেই গার্মেন্টস পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য ভুটান আমদানি করতে পারবে।”

এ সময় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ কাস্টমসের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের তিনটি এলসি পয়েন্ট দিয়ে ভুটান বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করবে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার এলসি পয়েন্টগুলো হলো নাকুগাও, গোবরাকুড়া ও করাইতলি।

“ভুটান বাংলাদেশে থেকে প্রধান পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক আমদানি করতে চায়। এর বিপরীতে পাথর, ফলসহ তাদের তৈরি পণ্য রপ্তানি করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন যেন নির্বিঘ্নে এই কার্যক্রম করা হয়। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। তবে তালিকাভুক্ত পণ্যের ১৯টি তালিকার বাইরেও পর্যারক্রমে আরও পণ্য রফতানি বাড়বে।

এর আগে ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনাম এল রাবগী নাকুগাঁও স্থলবন্দর পরিদর্শন করেছিলেন।

নাকুগাঁও স্থলবন্দরের কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে এ স্থলবন্দর থেকে আমদানি খাতে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে সাত কোটি ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অপরদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আমদানি খাতে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই কোটি ৪৩ লাখ চার হাজার টাকা।

করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে ২০২১ সালে থেকে রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ খাতে কোনো রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলেও জানান এ রাজস্ব কর্মকর্তা।