একেক রাতে একেক পাড়ায় গিয়ে কৃষকের ক্ষেত নষ্ট করছে হাতিগুলো। ফলে সংকটে পড়েছেন তিন পাড়ার প্রায় ২০০ পরিবার।
Published : 19 Jan 2024, 12:34 AM
বান্দরবান সদর উপজেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে এক মাসের বেশি সময় ধরে জমি, বাগান ও ফসলের ক্ষতি করছে একটি হাতির পাল; তাতে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা।
বনবিভাগ ও পাহাড়িরা জানান, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের কয়েকটি পাড়ায় ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ছোট-বড় ১১ হাতির ওই পাল। প্রতি রাতেই পটকা ফুটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
একেক রাতে একেক পাড়ায় গিয়ে কৃষকের ক্ষেত নষ্ট করছে হাতিগুলো। ফলে সংকটে পড়েছেন তিন পাড়ার প্রায় ২০০ পরিবার।
এর মধ্যে রাজবিলা ইউনিয়নেরর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ঝাংকাপাড়ার ৭১ পরিবার, তাইংখালীর ৫০ পরিবার এবং রাবার বাগান ৯ নম্বর ব্লকে ৬৭ পরিবারের বসবাস।
রাজবিলা ইউনিয়ন বান্দরবান জেলা হলেও ভৌগোলিক কারণে এলাকাটি রাঙ্গামাটির জেলার কাপ্তাই বনবিভাগের অধীনে পড়েছে।
ঝাংকাপাড়ার কারবারি (গ্রামপ্রধান) অংশৈ প্রু মারমা বলেন, তার নিজের ৮০০টি কলাগাছ, চার মণ কচু, মরিচ, দুই মণ আদা এবং চার একর জায়গায় ফুলঝাড়ুর ঝাড় ছিল। দুই রাতেই সব নষ্ট করেছে হাতির পাল।
“অথচ ফুল ঝাড়ু বিক্রি করেই চার-পাঁচ লাখ টাকা পাই। এত বড় ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। হাতি তাড়ানোর আর কোনো উপায়ও নাই। এই পাড়ায় আমরা ৭১টি মারমা পরিবার। কমবেশি সবারই এক অবস্থা,” বলেন কারবারি।
বনবিভাগের রাজবিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বুধবার বলেন, “হাতির ওই পাল দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে রয়েছে। আমি নিজেও সেখানে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। এখন রাজবিলা ইউনিয়নের রাবার বাগানের ৯ নম্বর ব্লক এলাকায় পালটি অবস্থান করছে।”
নিজেদের ক্ষতি হলেও হাতির ক্ষতি না করে ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের তিনি সহাবস্থানের পরামর্শ দিচ্ছেন।
রাজবিলা এলাকার পাহাড়গুলো খুব উঁচু নয়। ছোট ছোট টিলার মত। ঝাংকা ও নাইক্য খাল দুটি বেশ প্রবাহমান। দুটি খালেই বেশ পানি ও পাথর রয়েছে। খালের দু’পাশে রয়েছে ব্যক্তিগত কলাবাগান, পাহাড়ি ফুলঝাড়ুর ঝাড় এবং আদা-হলুদের ক্ষেত।
মঙ্গলবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে ঝাংকা খাল বেয়ে উঁচু-নিচু পাহাড় উঠতেই নাকে আসে হাতির বিষ্ঠার গন্ধ। বেশ খানিকটা পথজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিষ্ঠা। কোনোটা একেবারে কাঁচা, শুকায়নি। বোঝা যায়, অল্প সময় আগেই এখান দিয়ে গিয়েছে হাতির পাল।
পাশের কয়েকটি কলাবাগান ঘুরে মনে হল যেন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে গেছে। গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি কচু ও ফুলঝাড়ুর ঝাড়। আশপাশের কলা, পেঁপে, কুল ও সবজি বাগানের কমবেশি একই চিত্র।
ঝাংকাপাড়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপর একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাগানে নিয়ে যান কৃষক অংসাচিং মারমা।
নিজের ক্ষতিগ্রস্ত কলাবাগান দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, এখানে ৬০০টির মত কলাগাছ ছিল। এ ছাড়া তিন মণ আদা ও ছয় মণ কচু লাগানো ছিল। হাতির পাল সব ধ্বংস করে দিয়েছে।
আক্ষেপ করে এই চাষি বলেন, “হাতিদের খাদ্যের অভাব থাকলে খেয়েই চলে যাক। কিন্তু এমন না; অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক নষ্ট করে ফেলে তারা। এতগুলো ফসলের ক্ষতি হয়ে পথে বসার মত অবস্থা। পাড়াবাসী সবাই মিলে এত করে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। হাতিগুলো যাচ্ছে না কোথাও। একমাস ধরে এদিকে।”
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত চাষি পাইথুইঅং মারমা বলেন, “সজনে বাগানে ১০০টি গাছ ছিল। কোনো কোনো গাছ একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলেছে। কোনোটা ভেঙে দিয়েছে। গাছগুলো বড় ছিল আর ভালো ফুলও এসেছে। কয়েক মাস পর সজনে ভালো দামে বিক্রি করতে পারতাম। হাতির পাল শেষ করে দিয়েছে।”
৩৫০টি কলাগাছ, চার মণ আদা, চার মণ হলুদ, ২০০ পেঁপে গাছ এবং কয়েক একর জায়গায় ফুলঝাড়ুর ঝাড় তৈরি করেছিলেন পুথোয়াইচিং মারমা। এখন আর কিছুই নেই।
তিনি বলছিলেন, “হাতির পাল একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। গত বছর শুধু ফুলঝাড়ু বিক্রি করেই লাখ টাকা পেয়েছি। আমাদের মত প্রান্তিক কৃষকরা সহজে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না।”
স্থানীয়রা জানান, এলাকাটি বান্দরবান সদর উপজেলায় হলেও উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, ফলমূল তারা পাশের ৫ নম্বর ইসলামপুর বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন।
৫ নম্বর ইসলামপুর এলাকাটি রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা বাঙ্গাল হালিয়া ইউনিয়নে পড়েছে। ঝাংকাপাড়াটি একেবারে ইসলামপুরের পাশেই।
ইসলামপুরের সাপ্তাহিক হাট থেকে পাইকাররা শুধু ফুলঝাড়ুই সংগ্রহ করে থাকেন তিন থেকে চার ট্রাক। কিন্তু হাতির উপদ্রপ শুরুর পর এখন সেখানে আর ফুলঝাড়ু প্রায় মিলছেই না।
হাতির চলাচলের গতিপথ
স্থানীয়রা জানান, ১০-১৫ বছর আগে একবার এ এলাকায় হাতির পাল এসেছিল। তখন একটা নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘদিন এভাবে থাকত না। কয়েক দিন অবস্থান করার পর আবার দ্রুত চলে যেত। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। যদিও মানুষের ক্ষতি এখনও করেনি।
কৃষকদের ধারণা, হাতির পালটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বনবিভাগের অধীন দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য থেকে আসা। সম্প্রতি সেখানকার একটি বড় অঞ্চল প্রভাবশালীর দখলে চলে গেছে। ফলে সেখানকার বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়েছে। বিপদে পড়ে হাতির পালটি স্থানচ্যুত হয়েছে।
তবে রাজবিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, “হাতি চলাচলের নিয়ম হল, তারা যদি কোনো এলাকায় ১০০ বছর আগেও বসবাস করে থাকে। তাহলে কোনো একসময় তারা সেখানে গিয়ে পৌঁছাবে। হাতিদের বাবা-মা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের আবাসভূমি বলে যায়। এলাকাটি তো একসময় হাতির অভয়ারণ্য ছিল। এখন হয়তো লোকালয়ে ভরে গেছে।”
বনবিভাগের এই কর্মকর্তার পরামর্শ, এলাকায় হাতি ঢুকলে তাড়ানোর জন্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো, মশাল বা আগুন জ্বালিয়ে পিছন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু কোনোভাবে শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও নারীদের সামনে রাখা যাবে না।
“কোনোভাবেই হাতিকে অত্যাচার করা যাবে না, মারা যাবে না এবং ধরা যাবে না। হাতি যে জায়গায় আছে তাকে বিরক্ত না করে সেভাবেই থাকতে দিতে হবে। না হলে তারা মানুষের ক্ষতি করে বসবে।”
হাতির বিচরণের ভূমি প্রতিনিয়ত কমছে, নানা কারণে বন-জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে। খাবার ও আবাসস্থলের জন্য অনেক সময় লোকালয়ে নেমে আসে বন্যহাতি। এক্ষেত্রে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্বের জায়গায় নিরসন করার ওপর জোর দিচ্ছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলায় হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বনবিভাগের উদ্যোগে এলিফেন্ট রেসপন্স টিম-ইআরটি রয়েছে। হাতির সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, হাতিকে কীভাবে তাড়াতে হয়- এসব বিষয়ে গ্রামবাসী বা পাড়াবাসীকে সচেতন করেন ইআরটি সদস্যরা। কিন্তু বান্দরবানে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই।
বনবিভাগের এক কর্মকতা বলেন, “হাতি থাকবে, মানুষও বসবাস করবে। হাতিকে হাতির মত চলতে দিতে হবে। প্রকৃতিতে হাতি থাকতে হবে। হাতির বসবাসের জায়গায় মানুষকে দূরে থাকতে হবে। তাহলেই মোটামুটি একটা ভারসাম্য আসবে।”
ক্ষতিপূরণ
রাজবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য অং প্রু মারমা বলেন, হাতির পালের কারণে এরই মধ্যে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা পরিষদের কাছে আর্থিক সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পাঁচ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।
“কিন্তু হাতির বিষয়ে একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার, পাড়ার কারবারি এবং বনবিভাগ নিয়ে শিগগির সভা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজবিলা রেঞ্জ কর্মকতা কামাল হোসেন জানান, কেউ যদি হাতির আক্রমণে মারা যায় তাহলে সরকারি বিধি মোতাবেক তিনি ৩ লাখ টাকা পাবেন। আবার কেউ গুরুতর আহত হলে পাবেন ১ লাখ টাকা। তাছাড়া কারও যদি ক্ষেতের ফসল বা বাড়িঘর নষ্ট হলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পায়। এটা সরকারে বিধিবিধান আছে এবং একটা কমিটিও আছে।