নির্বিচারে ভাঙচুর, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট। বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ক্ষতি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।
Published : 18 Aug 2024, 12:56 PM
সরকার পতনের দিন ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কও। সেখান থেকে মূল্যবান যন্ত্রপাতির পাশাপাশি বেশি কিছু পাখিও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। অজগর সাপের বেষ্টনী খুলে ফেলার পর দুটি সরীসৃপের হদিস নেই।
দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকা সাফারি পার্কটির মেরামত করে আগের অবস্থায় কবে ফেরানো যাবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই কর্তৃপক্ষের। কারণ, এর জন্য যে বাজেট লাগবে, সেটি এই অবস্থায় পাওয়া যাবে কিনা, পেলে কত দিনে মিলবে, তাও জানা নেই তাদের।
হামলাকারীরা যেটা খুশি নিয়ে গেছে, অনেক কিছু ভেঙে দিয়ে গেছে। সরকার পতনের পর পুলিশের থানায় হামলার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত উধাও হয়ে যাওয়ায় আইনি প্রতিকারের সুযোগও পায়নি পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ এখন থানায় ফিরলেও তাদের অভিযানে যাওয়ার মত পরিস্থিতি হয়নি এখনও। এই অবস্থায় থানায় অভিযোগও জানাতে পারেনি পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পার্কটি খোলা থাকলে দিনে আয় হত চার থেকে ৫ লাখ টাকা। এই অর্থ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের অর্থেও টান পড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহম্মেদ নিয়ামুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখন কোনো আয় নেই। কিন্তু পশু-পাখির জন্য খাবারের খরচ হিসেবে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা খরচ করতে হচ্ছে।”
সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ কেবল নয়, পার্কের ভেতরে ইজারা নিয়ে যার খাবার দোকান চালু করেছিলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারাও। তাদের দোকান সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পার্ক কবে চালু হবে, সেই বিষয়টি অনিশ্চিত থাকায় তারা মেরামত করতেও আগ্রহী হচ্ছেন না। দোকানের কর্মীদেরও আয়ের পথ বন্ধ।
নির্বিচারে হামলা, ব্যাপক লুটপাট
গত ৫ অগাস্ট তুমুল গণ আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই সাফারি পার্কটিতে হামলা হয়।
বাংলাদেশে চিড়িয়াখানার ভেতরে খাঁচায় বন্দি প্রাণী দেখেই মানুষ অভ্যস্ত। ২০১৩ সালের অক্টোবরে রাজধানী থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ইন্দ্রপুরে চালু হওয়া এই পার্কটিতে পশুগুলো মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করে। দর্শনার্থীদেরকেই গাড়িতে খাঁচাবন্দি হয়ে হিংস্র প্রাণীর এলাকায় যেতে হয়।
উদ্বোধনের পর থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠা এমন একটি স্থাপনায় হামলা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। সেখানে বিদেশি নানা জাতের পাখিও ছিল, সেই পাখিগুলো পোষ মানা এবং মানুষের সঙ্গে খেলা করত। হামলার দিন পাখিও লুট করে নেওয়া হয়।
অনেক দর্শনার্থী জানে না যে পার্কটি বন্ধ, তারা ঘুরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজ আলী গ্রামের মোশাররফ হোসেন এদেরই একজন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি জানতাম না যে সাফারি পার্কে ভাঙচুর হয়েছে। ঘুরতে গিয়ে দেখি মেইন গেইট বন্ধ। পরে পূর্ব পাশের গেইট দিয়ে ঢুকে দেখি ভেতরে সব ছিন্নভিন্ন অবস্থা। কোনো লোকও নাই। তাই চলে এসেছি।
ইন্দ্রপুর এলাকারই বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “৫ অগাস্ট বিকাল ৪টার দিকে এক হাজারের বেশি মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে গেট ভেঙে পার্কে ঢুকে লুটপাট করেছে। তাদেরকে বাধা দেওয়ার মত কোনো পরিস্থিতি ছিল না।”
হামলাকারীরা ভাঙচুর ও লুটপাটের পাশাপাশি স্টিলের প্রধান ফটকটিও খুলে নীচে ফেলে দেয়। পার্ক কর্তৃপক্ষ সেটি উদ্ধার করে ঝালা দিয়ে আটকে দেয়। ফলে সেখান দিয়ে এখন ভেতরে যাওয়া আর সম্ভব না।
হামলাকারীরা প্রধান ফটকের ভেতরে থাকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, গ্যারেজে পার্কিং করা পর্যটক বহনকারী একটি মাইক্রো বাস, দুইটি জিপ ও ৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।
প্রধান ফটকের ভেতরে পূর্বপাশে থাকা ডিসপ্লে ম্যাপ, পার্ক অফিসের জানালার কাচ, ফ্যান ও কম্পিউটার, প্রিন্টার, পিসি, স্ট্যান্ড ফ্যান, ওয়াল ফ্যান, সিলিং ফ্যানও ভেঙে ফেলা হয়। লুট করা হয় সেখানে থাকা ল্যাপটপটি।
ডরমেটরি ভবন, রেস্ট হাউজ ময়ুরী ও ঐরাবতী, ফুডকোট-১ ও ২, শিশুপার্ক, মিউজিয়াম, প্রজাপতি কেন্দ্র, পার্ক অডিটোরিয়াম, কৃত্রিম উপায়ে পাখির ডিম ফুটানোর ইনকিউবেটর কক্ষও বাদ যায়নি। এগুলো ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি যা যা নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তার সবই নিয়ে গেছে তারা।
কর্মীদের আবাসিক ভবনের তিনটি কক্ষে আসবাবপত্র ও আলমারি ভাঙচুর, টিভি, ডেক্সটপ, টাকা, ব্যবহার্য জিনিসপত্র লুটে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। খুলে নেওয়া হয়েছে এসি। লুট হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। শিশুপার্কের বিভিন্ন ইভেন্টের মালামালও খুলে নেওয়া হয়েছে।
হামলাকারীরা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা মৃত পশু, পাখি, মাছের মূল্যবান নমুনা রাখার জারও ভেঙে দিয়েছে, জাদুঘরের দরজা জানলা, প্রজাপতি কর্নারে লাইফ সাইকেলও বাদ যায়নি।
পার্কের ইনকিউবেটর, এসি, ফ্রিজও ভাঙচুর করা হয়েছে। দুটি রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন স্থাপনায় থাকা সিটিটিভি ক্যামেরা, মনিটর, টিভি-সবেই নিয়ে গেছে।
কর্মীরা জানান, হামলাকারীরা সেদিন সাফারি পার্কে বাঘ-ভালুক-সিংহ বেষ্টনীও ভাঙচুর করতে গিয়েছিল। কিন্তু প্রাণীগুলো মুক্তভাবে বিচরণ করছে দেখে ফিরে আসে তারা। অজগর সাপের বেষ্টনী ভেঙে দেওয়ায় তিনটি সাপের মধ্যে দুটি বেরিয়ে গেছে। সেগুলোকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইনকিউবেটর রুমে থাকা ২টি ময়ূর ছানা ও পাখিশালা থেকে ৮টি টিয়া জাতীয় পাখিও লুট করে নিয়েছে হামলাকারীরা।
কবে খুলবে পার্ক?
সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহম্মেদ নিয়ামুর রহমান বলেন, “প্রাথমিক হিসাবে হামলা-ভাঙচুরের ফলে পার্কে আড়াই কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হামলার পর থেকে পার্কটি পর্যটকদের জন্য বন্ধ রয়েছে।”
পার্কটি কবে খোলা সম্ভব হবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এসব মেরামতের জন্য বাজেট দরকার। বাজেট পাওয়ার পর যথাসম্ভব দ্রুত মেরামত করে পার্কটি খুলে দেয়া হবে।”
পার্কটিতে বর্তমানে ৮টি বাঘ, ৪টি সিংহ, ১৪টি ভালুক, প্রায় দেড়শটি চিত্রা হরিণ, ৬টি মায়া হরিণ, ৬টি সাম্বার হরিণ, ৪০ টি জেব্রা, দুটি জিরাফ, ১২টি ওয়াইল্ড বিস্ট, ১১টি গয়াল, ৯টি নীলগাই, ১১টি কুমির, ৫টি ঘড়িয়াল, ৩টি লেমুর ও ৪টি জলহস্তী আছে।
পাখির মধ্যে আছে দুইশর বেশি টিয়া, ১১টি উটপাখি, ৮টি মদন টাক, ৩০টি ম্যাকাও, ৯টি ইমু, ১৭টি শকুন, শতাধিক ময়ূর।
আরও পড়ুন:
গাড়ি নেই, অস্ত্র লুট, পুলিশ এখন কী করবে?
মেয়র আইভীর বাড়ির ইট খুলে নেওয়ার হুমকি বিএনপি নেতার
সরকার পতন: দেশজুড়ে বেপরোয়া হামলা, লুট, অগ্নিসংযোগ
মুজিবনগরে তাণ্ডবের বলি মুক্তিযুদ্ধের ৩০০ ভাস্কর্য
সরকার পতন: পথে পথে সহিংসতার দগদগে ছাপ
সরকার পতন: তাণ্ডবের ক্ষত জেলায় জেলায়, কাটেনি আতঙ্কও