“বর্তমানে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ টন ময়লা এখানে ফেলা হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে।”
Published : 13 Dec 2024, 10:44 AM
কুমিল্লা নগর থেকে ভারত সীমান্তবর্তী বিবির বাজার সড়ক ধরে ঝাঁকুনিপাড়া-দৌলতপুর এলাকায় গেলেই দূর থেকে চোখে পড়বে উঁচু উঁচু পাহাড়। তবে আরও এগিয়ে গেলে নাকে ধাক্কা দেওয়া দুর্গন্ধই বুঝিয়ে দেবে সেগুলো আসলে মাটির পাহাড় নয়।
বরং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ফেলা ময়লা-আবর্জনার (বর্জ্য) স্তূপ জমে সেখানে এই পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে নাকাল হচ্ছেন কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়ন সংলগ্ন ১০টি গ্রামের অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ।
প্রায় তিন দশক ধরে চলা এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করলেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে অবস্থাটা এমন হয়েছে যে ময়লা-দুর্গন্ধের কারণে ওই গ্রামগুলোতে কেউ আত্মীয়তাও করতে চান না।
সিটি করপোরেশন বলছে, বর্জ্য রি-সাইকেলিং করে কীভাবে কাজে লাগানো যায়- সেই চেষ্টা করছে তারা।
তিন দশকের দুর্ভোগ
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় তিন দশক থেকে ওই স্থানে কুমিল্লা নগরের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আগে কুমিল্লা পৌরসভা এখানে ময়লা ফেলতো। ২০১১ সালে কুমিল্লা পৌরসভা ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ পৌরসভাকে নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠিত হয়।
পরে বেশ কয়েক বছর আগে ঝাঁকুনিপাড়া-দৌলতপুর গ্রামে প্রায় ১০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। এরপর থেকেই নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ ময়লা এখানেই ফেলছে সিটি করপোরেশন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ময়লার স্তুপের উত্তর পাশ দিয়েই গেছে বিবির বাজার স্থলবন্দর সড়কটি। সড়কটি দিয়ে চলাচলের সময় দূর থেকেই নাকে ভেসে আসে তীব্র দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধ এতোটাই তীব্র, নাক চেপে চলাচল করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
অপরিকল্পিতভাবে ফেলার কারণে ময়লা আবর্জনার স্তূপ সিটি করপোরেশনের জায়গা ছাড়িয়ে ওই এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ির আশপাশসহ সড়কের পাশে ছড়িয়ে পড়ছে। সামান্য বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ।
সেখানে ভেতরে মানুষ প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সীমানা প্রাচীর না থাকায় অবাধে গরু-ছাগল ঢুকে পড়ছে। ময়লার স্তূপ থেকে উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে প্রাণীগুলো।
ভোগান্তি দশ গ্রামের মানুষের
স্থানীয়দের দাবি, এখানে বর্জ্য ফেলার কারণে ঝাঁকুনিপাড়া, দৌলতপুর গ্রামের পাশাপাশি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাজগড্ডা, খামার কৃষ্ণপুর, শুয়ারা, জগন্নাথপুর, নবগ্রাম, বালুতুপাসহ আশপাশের অন্তত দশটি গ্রামের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা সামছুল আলম বলেন, “পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর সীমানা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে জনসংখ্যাও। ফলে ময়লা-আবর্জনার পরিমাণও প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
“এতে দিন যত যাচ্ছে, ততই অতিরিক্ত ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে অসহনীয় হয়ে উঠছে মানুষের বসবাস। বর্তমানে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ টন ময়লা এখানে ফেলা হচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ময়লা ফেলা হচ্ছে।”
একই এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন বলের, “ময়লা ফেলার জায়গার তিন দিকে আংশিক সীমানা প্রাচীর থাকলেও উত্তর দিকে কোনো প্রাচীর নেই। তবে যেই তিন দিকে প্রাচীর রয়েছে, সেখানেও ময়লার স্তূপ পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এই এলাকার মানুষকে প্রতিদিনই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।”
ঝাঁকুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, “সিটি করপোরেশন আমাদের এলাকায় ময়লা ফেলে ফেলে পাহাড় বানিয়েছে। এই ময়লার পাহাড়ের কারণে আমাদের এলাকার মানুষ প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
“সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো আমাদের এলাকায় ভালো কোনো পরিবারের লোকজন আত্মীয়তাও করতে চায় না। কেউ আত্মীয়তা করতে এলেই ময়লাখোলার অবস্থা দেখে আর ভয়াবহ দুর্গন্ধে দ্রুত চলে যায়।”
ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও
বছরের পর বছর ধরে ওই স্থানে কোনো প্রকার সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। এতে স্থানীয় মানুষদের ভোগান্তির পাশাপাশি সর্বনাশ হয়েছে পরিবেশেরও।
মোজাম্মেল হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “এই ময়লার পাহাড়ের দুর্গন্ধ এক মাইল দূর থেকেও পাওয়া যায়। বৃষ্টির হলেই এসব ময়লা-আবর্জনা আশপাশের জলাশয় ও রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। চরম ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।
“এতে স্থানীয় মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি চাই।”
পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব বলেন, “এভাবে বর্জ্য ফেলায় পরিবেশ মারাত্মভাবে দূষণ হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে- তারা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে বর্তমানে প্রকল্পটি কোন পর্যায়ে আছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। কীভাবে পরিবেশ দূষণ না করে ময়লা-আবর্জনাকে নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ রাখা যায়- প্রকৃতপক্ষে এটা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা উদ্যোগ কর্তৃপক্ষের ছিল বলে আমাদের কাছে কখনোই মনে হয়নি।
“অপরিকল্পিতভাবে ময়লা ফেলার কারণে ওই এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। দ্রুত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করতে হবে। সেটা না হলে সামনে ভয়াবহতা আরও বাড়বে।”
তিনি আরও যুক্ত করেন, “শুধু ওই এলাকাই নয়, নগরের বিভিন্ন খোলা স্থানেও ময়লা ফেলে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”
কী বলছে সিটি করপোরেশন
বছরের পর বছর ধরে এভাবে খোলা স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে স্থানীয় এলাকাবাসীসহ পরিবেশকর্মী ও সংগঠকেরা।
এরই প্রেক্ষিতে গত প্রায় ৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশন বলছে- নগরের এসব ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ওই এলাকাগুলোর মানুষ বিষাক্ত দুর্গন্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন।
এরই মধ্যে একাধিকবার এই প্রকল্প গ্রহণ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, আগে যেই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল সেটা আপাতত স্থগিত হয়ে রয়েছে।
আমরা প্রকল্পটির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে, সেখানে থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়।কিন্তু এরপর বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে আর কিছু জানানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, “তবে আমরা এই সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করছি। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে হলেও বর্জ্য রি-সাইকেলিং করে কীভাবে কাজে লাগানো যায়- সেই চেষ্টা করছে সিটি করপোরেশন।”