Published : 26 Oct 2024, 10:32 PM
বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসা মাদারীপুরের কালকিনির কুণ্ডুবাড়ির কালীপূজা মেলা এবার বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন, বাতিল করা হয়েছে ইজারাও।
কয়েকজন আলেম ও ছাত্রপ্রতিনিধিদের অভিযোগের পর প্রতিবছর কালিপূজাকে ঘিরে আয়োজিত প্রায় ২২০ বছরের পুরনো সপ্তাহব্যাপী মেলাটি বন্ধ করার তথ্য দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন; তবে শেষ সময়ে আয়োজনে একেবারে হালও ছেড়ে দিচ্ছে না।
এরইমধ্যে মেলা বন্ধের ব্যানার টাঙানো হয়েছে উপজেলা সদরের ভুরঘাটা বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে। এমন একটি ব্যানারে লেখা রয়েছে- “এ বছর (২০২৪) থেকে কুণ্ডুবাড়ির মেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হলো- বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণ।”
মেলা বন্ধের প্রসঙ্গে কালকিনির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উত্তম কুমার দাশ বলেন, “বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি। এবং মেলাটি সপ্তাহব্যাপী না করেও যদি কিছু শর্তে সীমিত পরিসরে অন্তত তিন দিন করা যায় সে ব্যাপারে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
তবে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কুণ্ডুবাড়ির কালীপূজা যথারীতি হবে, বলেন তিনি।
কালকিনি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন এরইমধ্যে মেলা উপলক্ষে ইজারা বাতিল করে দিয়েছে।
ফলে মেলা হচ্ছে না ধরে নিয়ে কুণ্ডুবাড়ির কালীমন্দিরের পরিচালনা কমিটি শুধু পূজা আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ৩১ অক্টোবর কালীপূজা ও দীপাবলির অনুষ্ঠান হবে।
১৮০৫ সাল থেকে প্রতিবছর কালীপূজা শুরুর দিন থেকে এ মেলা আয়োজন করার তথ্য মিলেছে।
ইউএনও উত্তম কুমার বলেন, “এবার স্থানীয় ২১ জন আলেম ও ছাত্রপ্রতিনিধি আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করে মেলা বন্ধ করার জন্য লিখিত অভিযোগ দেন। তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন এবার মেলা আয়োজন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।”
শনিবার কালকিনি পৌরসভার ভুরঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তবে তারা এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
কয়েকজন বলছিলেন, এই মেলা তো সবার। সাত দিন এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ এখানে আসে। কোটি কোটি টাকা বেচাকেনা হয়। কিন্তু পূজা তো হয় একদিন।
এলাকার সাধারণ মানুষের কথা ও ঐতিহ্য বিবেচনায় তাদের কয়েকজন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করার দাবি তোলেন।
কুণ্ডুবাড়ির ঐতিহ্যবাহী এ মেলা বন্ধের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিকল্প কিছু করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবার কথা বলেছে প্রশাসন।
১৮০৫ সাল থেকে মেলা শুরু
শনিবার সকালে ভুরঘাটার কুণ্ডুবাড়ি কালীমন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, সুনশান নিরবতা। অথচ পূজার আগের এ সময়টায় লোকজনের কোলাহলে মুখরিত থাকত। মন্দির চত্বরের বাইরে সরকারি ও ব্যক্তিগত মিলিয়ে চার একর জায়গায় মেলা হয়।
মেলায় দোকান বসাতে জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাসহ প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলত। এবার এসবের কিছুই নেই।
তবে ভেতরে কালী প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। সেখানে শিল্পীরা কাজ করছিলেন। বাইরে মন্দিরের প্যান্ডেলে বসে তদারকি করছিলেন কয়েকজন।
সেখানে কালীমন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কালীপদ কুণ্ডুর ছেলে স্বপন কুণ্ডু বলছিলেন, কুণ্ডুবাড়ির মেলাটি দেশের বড় মেলাগুলোর একটি। ১৮০৫ সালে এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দীপাবলি ও কালিপূজা উপলক্ষে ‘কুণ্ডু মেলা’ শুরু করেন দীননাথ কুণ্ডু ও মহেশ কুণ্ডু। কালে কালে সেটি কুণ্ডু বংশের নামানুসারে ‘কুণ্ডুবাড়ির মেলা’ নামকরণ হয়ে যায়। মানুষের সমাগম ও আগ্রহের কারণে পরে মেলার সময়ও বেড়েছে।
“প্রতিবছর কালীপূজার সময় সাত দিন এ মেলা হয়। ক্রেতাদের সমাগমের কারণে কোনো কোনো বছর এ মেলা ১৫ দিন পর্যন্ত চলে। কোনোদিন কোনো সমস্যা হয়নি।”
সোয়া দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা এ মেলা এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ায় আক্ষেপ স্বপন কুণ্ডের।
যেসব অভিযোগ
ভুরঘাটা এলাকার ২১ জন আলেম ও ছাত্রপ্রতিনিধির স্বাক্ষরে গত ১৬ অক্টোবর কালকিনির ইউএনওর কাছে মেলা বন্ধের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এতে নয়টি কারণ তুলে ধরা হয়।
অভিযোগের মধ্যে প্রতি বছর মেলায় মারামারি ও গত বছর খুনের কথা তুলে ধরা হয়। মেলায় জুয়ার আসর বসানোর পাশাপাশি মদ-গাঁজার আড্ডা, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, যানজট ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়।
তবে পূজা বন্ধের কোনো ইচ্ছা তাদের নেই বলেও আবেদনে বলা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে স্বাক্ষরদানকারী মাওলানা আবদুল বারি বলেন, “এলাকার মুসল্লিরা মেলায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় বিধায় আপত্তি দেওয়ায় আমরা মেলা বন্ধের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছিলাম। প্রশাসন মেলা বন্ধ করবে কি-না সেটা প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।”
মেলায় মেয়েদের নানা ধরনের হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেন আরেক স্বাক্ষরদানকারী ইমামুল ইসলাম।
“এটা আমরা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছি। অভিযোগপত্রের কারণগুলোর জন্যই মেলা বন্ধর দাবি করেছিলাম। এখন প্রশাসন কী করবে তা জানি না।”
কালকিনির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব দলিল উদ্দিন হাওলাদার ছোটবেলা থেকেই মেলায় আসছেন। বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কেনাকাটা করেন। আগে ছেলেমেয়েকে নিয়ে গেছেন মেলায়। এখন নাতি-নাতনিদের নিয়ে যান। আনন্দ পায় বলে বাচ্চা কাচ্চারা যেতে চায়।
দলিল উদ্দিন বলছিলেন, “কই কখনো তো কোনো ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কথা শুনিনি। কিন্তু এবার শুনতেছি আলেম সমাজ আপত্তি জানিয়েছে।”
এসব নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক না বলে মনে করেন তিনি।
এবার মেলা না হওয়ার সিদ্ধান্তে মন খারাপ কুণ্ডুবাড়ির দুই তরুণ আকাশ কুণ্ডু ও গোপাল কুণ্ডুর।
আকাশ বলছিলেন, “কালীপূজার মেলা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। তবে মেলা হোক বা না হোক, আমরা আমাদের পূজা চালিয়ে যাব। পুরো মন্দিরকে নতুন করে রং করছি। নতুন প্রতিমা বানানোর কাজ প্রায় শেষ; এখন শুধু রং করা বাকি।”
হঠাৎ মেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কুণ্ডুবাড়ির কালীমন্দির কমিটির উপদেষ্টা বাসু দেব কুণ্ডু।
“বাজারে কারা মেলা বন্ধের ব্যানার টানিয়েছে, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনাদের। আর বেশি কিছু বলে আমরা বিপদে পড়তে চাই না। আমরা আমাদের পূজা নিয়ে থাকব।”
‘তারা মেলা করতে নিষেধ করেছে’
সপ্তাহব্যাপী এ মেলায় তৈজসপত্র, কুটিরশিল্প, ফার্নিচার, মিষ্টি, বাচ্চাদের খেলনা, শাঁখা-সিদুর-চুরি, খাবারসহ কয়েকশ দোকান বসে। কালকিনি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ জায়গা ইজারা দেয়। চলতি বছর দুই লাখ ৮০ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন স্থানীয় আকবর হোসেন, যিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ইজারা নিচ্ছেন।
আকবর বলেন, “এবার প্রশাসনের কাছে হুজুররা আইন-শৃঙ্খলা অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় মেলা না করার জন্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তারা আমাকে মেলা করতে নিষেধ করেছেন।”
তার ভাষ্য, “আমি পৌরসভা থেকে ইজারা নিয়ে কয়েকশ দোকানির কাছে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি। এসব দোকানি ঋণ করে লাখ লাখ টাকার মালামাল কিনেছে মেলায় বিক্রি করার জন্য। তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
“এখন এই মেলা না হলে এসব দোকানি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া আমারও আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতি হবে।”
মেলা ফেরানোর চেষ্টা
তবে এখনও হাল ছাড়তে রাজি নন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ মন্দির কমিটির নেতারা। তারা উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করছেন।
শনিবার দুপুরে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদসহ সনাতন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা কালকিনির ইউএনওর সঙ্গে মতবিনিময় করে মেলা বন্ধ না করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
সভা শেষে মাদারীপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক প্রাণতোষ মণ্ডল বলেন, এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মেলাটির আয়োজন ধরে রাখতে ডিসি ও পুলিশ সুপার সঙ্গে আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
কালকিনির ইউএনও উত্তম কুমার বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মেলার বিষয়টি নিয়ে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।