নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হেল্প লাইনে কল পেলেই তাদের উদ্ধার করছেন।
Published : 28 Aug 2024, 06:16 PM
নোয়াখালী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের কাউয়ুমের দোকান এলাকার বাসিন্দা বিবি আয়েশা যখন সন্তান প্রসবের দিন গুনছেন, ঠিক তখনই তার বাড়ির উঠানে পানি জমতে শুরু করে। বেলা গড়াতে থাকলে ঘরেও পানি চলে আসে।
বিবি আয়েশা ও তার পরিবার চিন্তায় পড়ে যান। কারণ, পানি ভেঙে কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া এলাকায় কোনো নৌকা বা স্প্রিডবোটেরও সন্ধান পাচ্ছেন না তারা। এদিকে বিবি আয়েশার শরীরও খারাপ হতে থাকে।
শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে যোগযোগ করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে; যারা বন্যা দুর্গতদের উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে অংশ নিচ্ছেন।
খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে একদল শিক্ষার্থী নৌকা নিয়ে গিয়ে বিবি আয়েশাকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মো. ইদ্রিস অডিটরিয়ামে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রে তোলেন শিক্ষার্থীরা।
সেদিন রাত ও শুক্রবারটা অন্য অনেক বন্যার্তের সঙ্গে ভালই কাটে বিবি আয়েশার। কিন্তু শনিবার রাত ২টায় তার প্রসব বেদনা তীব্র হয়ে ওঠে। আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক নেই, চিকিৎসাও নেই।
তাৎক্ষণিক শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্সে করে বিবি আয়েশাকে ২৫০ শয্যার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। রোববার আয়েশা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। মা ও সন্তান একটু সুস্থ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরাই তাদের আবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। তাদের রাখা হয় ছাত্রীদের হলে। সেখানেই স্বেচ্ছাসেবকরা পালা করে মা ও সন্তানের যত্ন নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা বিবি আয়েশার কন্যাসন্তানের নাম রেখেছেন, মুসকান নূর ফারহান।
বিবি আয়েশার মতো শনিবার এই ইউনিয়নের আব্দুর রহমানের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী নারগিস আক্তারকেও উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। বাড়ি থেকে নৌকায় করে নারগিসকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
ওই রাতেই সেখানে তিনি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। তারপর শিক্ষার্থীরা তাকে ছাত্রী নিবাসে নিয়ে এসে রাখেন। শিক্ষার্থীরা শিশুটির নাম রাখেন ‘আজমাইন রহমান প্লাবন’।
দুই প্রসূতি মা ও তাদের সন্তানরা ভাল আছেন বলে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না ফেরদৌস। তিনি বলেন, “আরও একজন প্রসূতি মা ও শিশু এখানে আছেন। আমরাই তাদের যত্ন করছি। যখনি এমন কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন আমরা দ্রুততার সঙ্গে নৌকা নিয়ে গিয়ে তাদের সহায়তা করছি। সন্তান প্রসবে সাহায্য করছি।”
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এখন নারী, পরুষ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীসহ ২৩৮ বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। যেখানে তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, ওষুধ সবই শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে ব্যবস্থা করছেন।
সদ্য প্রসূতি নারগিস আক্তার বলছিলেন, “বাড়িতে পানি উঠে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমাকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এরপর পেইন উঠছে, তারা আমাকে হাসপালে নিয়ে যান। বাবু হওয়ার পর তারা আবার আমাকে এখানে ছাত্রীদের হলে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাকে আর আমার বাচ্চাকে আদর-যত্ন করে আগলে রেখেছেন।”
ধর্মপুর ইউনিয়নের শল্লা এলাকার শারমিন আক্তার মাত্র দুদিন আগে সিজারের মাধ্যমে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তারপর বন্যার পানি আসতে থাকলে চিকিৎসক তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে পানির কবলে পড়েন। একপর্যায়ে সদ্যজাত সন্তান নিয়ে শারমিন পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
তখন তারা হেল্প লাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শিক্ষার্থীরা নৌকা নিয়ে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। তখন তারাও ছাত্রী নিবাসে আছেন। শারমিন তার কন্যার নাম রেখেছেন জান্নাত।
শারমিন আক্তার বলছিলেন, “আমাদের বাড়িতে পানি উঠে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আপু ও ভাইয়াদেরকে ফোন করে আমাদেরকে উদ্ধারের কথা বলা হয়। এরপর আপু-ভাইয়ারা এখান থেকে নৌকা নিয়ে অনেক কষ্ট করে আমাকে ও আমার বাবুকে এখানে নিয়ে আসে। এখানে তারা আমাদেরকে অনেক যত্ন করছেন। তাদের এ ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।”
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপের টিম লিডার মেহেদী হাসান সৈকত বলেন, “শিক্ষার্থীদের অনেকগুলো টিম প্রতিদিন উদ্ধার কাজ, ত্রাণ তৎপরতাসহ আশ্রয়কেন্দ্রে পালাক্রমে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি মানুষের তালিকা, ত্রাণ তৎপরাসহ অন্যান্য তথ্য ভাণ্ডার করেছে। প্রতিদিনই হেল্প লাইনে কল পেলে উদ্ধার ও ত্রাণ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।”