পাহাড়ে সংঘটিত ‘সাম্প্রদায়িক হামলার’ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
Published : 03 Oct 2024, 11:08 PM
গত মাসে খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সহিংসতার পেছনে ‘অপপ্রচারকে’ দায়ী করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
বৃহস্পতিবার সংগঠনটির পক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, সহিংসতায় যে ৪ জন জুম্ম নাগরিক নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ‘সেটেলার বাঙালিদের’ হামলায় দুইজন ও ‘সেনাবাহিনীর গুলিতে’ দুইজনের প্রাণ গেছে।
তবে সেনাবাহিনীর দাবি, “ইউপিডিএফ (মূল) এর ‘সন্ত্রাসীরা’ সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়।”
গত ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর পাহাড়ের ওই ঘটনাকে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ হিসেবে বর্ণনা করে জনসংহতি সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়, “গত ১৮-১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি সদরে বিশেষ মহলের সহযোগিতায় ‘সেটেলার বাঙালিরা’ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। হামলায় জুম্মদের শতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ও ঘরবাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।”
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “গত ১৮ সেপ্টেম্বর মো. মামুন নামের এক সেটেলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এলাকা থেকে গোল্ডি চাকমা নামে একজনের মোটরসাইকেল চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তার পাশের একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মামুন বাইক থেকে পড়ে যান এবং গুরুতর আহত হন।
“তখন আশেপাশের বাঙালি ও জুম্ম জনতা এসে ‘চোর, চোর’ বলে মামুনকে মারধর করে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।”
নিহত মামুনকে ‘পেশাধার চোর’ হিসেবে বর্ণনা করে জনসংহতি সমিতি বলছে, “এ ঘটনায় ১৯ সেপ্টেম্বর মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তারে দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় শাকিল, রফিকুল আলম ও দিদারুল আলমকে, যারা প্রত্যেকেই বাঙালি। কিন্তু তার মৃত্যুর পরেই বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রচার করতে থাকে, জুম্মরাই পরিকল্পিতভাবে মামুনকে মেরে ফেলেছে। অপপ্রচার চালিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুরে হামলার চেষ্টা করে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।
“১৯ সেপ্টেম্বর বিকালে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ব্যানারে বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দীঘিনালা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের শেষদিকে তারা দীঘিনালা সদরে জুম্মদের উপর লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল দিয়ে হামলা করে। এ সময় রিপুয়ে চাকমা নামে একজন জুম্ম আহত হন।
“এসময় আশেপাশের জুম্মরা ‘উজো উজো’বলে আক্রান্তদের বাঁচাতে এগিয়ে আসলে সেটেলার বাঙালিরা পিছু হটে। সেটেলার বাঙালিরা যখন পিছু হটতে থাকে তখনি সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে আসে এবং জুম্মদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়। সেনা সদস্যরা জুম্মদেরকে বলে, ‘তোমরা চলে যাও, কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি। তোমরা এখানে থাকলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, জুম্মরা চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই ‘সেটেলার’ বাঙালিরা আবার দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দীঘিনালা সদরে হামলা চালায়। তারা বটতলার লারমা স্কয়ার স্টেশন বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। তাতে জুম্মদের অন্তত ৫২টি দোকান ও বাড়ি এবং ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিকশা ভস্মীভূত হয়।
ওই হামলায় কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাবি করে সন্তু লারমার দল জনসংহতি সমিতি বলেছে, এরপর দীঘিনালা সদরের কলেজ টিলা ও বাবু পাড়ায় হামলার চেষ্টা হয়।
“সেসময় জুম্ম গ্রামবাসীরা সংঘবদ্ধ হয়ে সেটেলার বাঙালিদের প্রতিরোধ করে। এভাবে প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালিরা হামলা ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালিয়ে থাকে।
“এ হামলায় মাইনী ব্রিজ এলাকায় দীঘিনালা সদরের উদোলবাগানের হান্দারা চাকমার ছেলে ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নামে এক জুম্ম মৃত্যুবরণ করেন। ধন রঞ্জন চাকমার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দীঘিনালায় সেটেলারদের হামলায় এবং সেনাবাহিনীর লাঠিপেটায় কমপক্ষে ৪ জন জুম্ম আহত হয়।”
খাগড়াছড়ি সদরে গুলির বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বলছে, “জুম্ম ছাত্ররা কান্তা-গুলতি ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী সেখানে গুলিবর্ষণ করে। এসময় সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ২০ জুম্ম ছাত্র-যুবক আহত হয়। স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা মারা যান।”
রাঙ্গামাটি সদরে হামলার বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “সেটেলার বাঙালিরা বনরূপায় জুম্মদের বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। সেটেলার বাঙালিরা সেভরন ও মেডিনেট ক্লিনিকে, বিজন সরণী এলাকায় জুম্মদের বিভিন্ন দোকানপাটে, জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।”
“বনরূপা ও কালিন্দীপুরে হামলায় অনিক কুমার চাকমা নামে এক জুম্ম যুবক নিহত এবং প্রায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়। তন্মধ্যে হাসপাতালে আহত ২৭ জন জুম্ম, রাজবন বিহার হাসপাতালে ২৫ ও ঘরে ঘরে ২৮ জন জুম্ম চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে।”
সেদিন মৈত্রী বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাটসহ জুম্মদের ২৪টি ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করার অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছ বিবৃতিতে। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতার প্রেক্ষিতে ২০ সেপ্টেম্বর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “১৯ সেপ্টেম্বর একটি টহল দল রাত সাড়ে ১০টার দিকে মুমূর্ষু এক রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে ‘উত্তেজিত জনসাধারণ’ ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফ (মূল) এর ‘সন্ত্রাসীর’ সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়।”
আইএসপিআরের তরফে সেদিন সতর্ক করে বলা হয়, “খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে।”
ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বলেছে, “ওই বক্তব্য অনেকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম প্রচারণার সামিল, যা দাঙ্গাকারীদের দাঙ্গা সংঘটনে উসকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।”
এ অবস্থায় খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত ‘সাম্প্রদায়িক হামলার’ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান ও হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।