পাউবো প্রকৌশলী বলেন, “বর্ষায় ফসলরক্ষা বাঁধটি কেটে দেওয়ার পর জয়পুর গ্রামে গিয়ে তীব্র স্রোত আছড়ে পড়ে গ্রামের বসত বাড়িগুলোর ক্ষতি করছে।”
Published : 16 Nov 2024, 10:43 AM
গ্রামটির নাম জয়পুর। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের মরে যাওয়া বেলা নদীর তীরে ছোট গ্রামটির অবস্থান। ছায়ার হাওর ও উদগল হাওর গ্রামটিকে চারদিকে পেঁচিয়ে রেখেছে। ছোট্ট বেলা নদীটি গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে এসে ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। নদীটি হারিয়েছে তার স্বাভাবিক রূপ। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া এই নদীটির সামান্য অংশ একটি গ্রামকে বিলীন করে দিয়েছে গত সাত বছরে।
গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, হেমন্তে যাতায়াতের সুবিধার্থে হাওরের ফসলরক্ষার কথা বলে বাঁধটি নির্মিত হওয়ায় গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবারের বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের মুখে বাঁধটি নির্মিতও হয়েছে ফসলরক্ষা বাঁধের টাকায়।
প্রবল বর্ষায় আবার পানির চাপ কমাতে বাঁধটি কেটে দেওয়া হয়। তখনই তীব্র স্রোতের তোড়ে বাঁধের মুখে (পশ্চিমে) থাকা গ্রামটিতে ভাঙন দেখা দেয়। বাঁধের নিচে দেখা দিয়েছে গহীন কোর (গর্ত)।
এই অবস্থায় বসতভিটা হারানো গ্রামের হতদরিদ্র মানুষজন পাশেই মিলনবাজারের কাছে নাসিরপুর গ্রামের সামনে কিছু জমি কিনে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু অর্থাভাবে সেটাও ভরাট করতে পারছেন না।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ মো. ইমদাদুল হক বলেন, “বর্ষায় ফসলরক্ষা বাঁধটি কেটে দেওয়ার পর জয়পুর গ্রামে গিয়ে তীব্র স্রোত আছড়ে পড়ে গ্রামের বসতবাড়িগুলোর ক্ষতি করছে।
“এখানে বাঁধ রাখা না রাখা নিয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চিন্তা করছেন। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাছাড়া গ্রামটি রক্ষায় ভাঙন রোধেও প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছি আমরা।”
‘৬০ ঘরের ৩০টি চলে গেছে’
সম্প্রতি জয়পুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মিলনবাজার থেকে একটি ডুবন্ত সড়ক জয়পুরের সামনে দিয়ে শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে চলে গেছে। এই গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০টি পরিবার বসবাস করে। গ্রামটির সামনে উদগল হাওর আর পেছনে ছায়ার হাওর। মাঝখানে গ্রাম আর ভরাট হয়ে যাওয়া বেলা নদী। গ্রামের সামনে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের টাকায় এই মৌসুমে যে বাঁধ তৈরি করা হয় সেটা ভেসে ওঠেছে। প্রস্তুতি চলছে নতুন বাঁধ নির্মাণের।
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, কেবল মিলনবাজার থেকে সরাসরি শাল্লা উপজেলায় যাওয়ার জন্যই এখানে হাওরের টাকায় বাঁধটি প্রতি বছর তৈরি করা হয়। মাটি ভরাটের জন্য চার-পাঁচটি প্রকল্পে অন্তত কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত সাত বছরে এখানে অন্তত সাত কোটি টাকার মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের আগে এই গ্রামের পিছনে ছায়ার হাওরের বাঁধ দেওয়া হতো। সেখান থেকে যাতায়াতের কথা ভেবেই পিছন থেকে সামনে নিয়ে আসা হয় বাঁধটি। তারপরই গ্রামবাসীর এই দুর্গতি। বাস্তুচ্যুত হতে শুরু করেছেন তারা।
অথচ এই বাঁধটি থাকা না থাকার উপর হাওরের ফসলহানির কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানান গ্রামের দুজন প্রবীণ। তারা বলেন, বৈশাখে হাওরের ধানকাটা শেষে বর্ষায় বাঁধের ভেঙে দেওয়া অংশ দিয়ে পশ্চিমে মাত্র ১৫০-২০০ গজ দূরে জয়পুর গ্রামটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে উদগল হাওরের প্রবল স্রোত।
এভাবেই ভেঙে যেতে শুরু করে গ্রামটি। প্রতি বছর এভাবেই একই স্থানে অপরিল্পিত বাঁধ দেওয়ায় বর্ষায় ভেঙে দেওয়ার পর গ্রামের অন্তত ৩০টি বসতবাড়ি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন তারা।
এর আগে গ্রামের পুরনো দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
অপ্রয়োজনীয় বাঁধের কারণে সরকারের অর্থ অপচয়ের সঙ্গে বসতবাড়ি বিলীন হওয়ায় ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি অবগত করে বাঁধ এখান থেকে সরিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে যেতে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছেন গ্রামবাসী।
গ্রামের বাসিন্দা সৌমেন চৌধুরী বলেন, “২০১৭ সালের হাওরের ফসল নষ্ট হওয়ার পরই বাঁধটি আমাদের গ্রামের পশ্চিম থেকে পূর্বে নিয়ে আসা হয়। ধান কাটা শেষে হলে যখন বাঁধ কেটে দেওয়া হয় তখন সরাসরি গ্রামে আছড়ে পড়ে উদগল হাওরের জমা জল। আর ভাঙতে থাকে গ্রামটি। ৬-৭ বছরে আমাদের গ্রামের ৩০টি পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা কয়েকটি পরিবার মিলে পাশে মিলনবাজারের কাছে (নাসিরপুর) পশ্চিমে জায়গা ক্রয় করেছি নতুন গ্রাম তৈরি করার জন্য। যেখানে বাঁধেরই প্রয়োজন নেই সেখানে প্রতি বছর বাঁধ দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি একটি জনপদকে বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, গ্রামবাসী এ ঘটনায় আবেদন-নিবেদন করেও গ্রামটি রক্ষা করতে পারছে না।
আতঙ্ক নিয়ে বসবাস
গ্রামের কৃষক তপন দাস বলেন, “গত বছর প্রথমে আটটা, এই বছর সাতটা ঘর ভাঙছে। প্রতি বছরই ঘর ভাঙায় মানুষ চলে যাচ্ছে। আমরা যে কয়েকটি ঘর এখনো আছি তারাও আতঙ্কে আছি। গ্রামটি বিলীন হওয়ার পথে।
“বর্ষায় যখন বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয় তখন পুরো জল আছড়ে পড়ে গ্রামে। তুলোর মতো মাটি উড়িয়ে নেয়। যদি নদীর কোর (ভাঙন কবলিত গভীর অংশ) ভরাট করে দেয় বা বাঁধটি স্থায়ী করে দেয় তাহলে অবশিষ্ট গ্রামবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব। না হলে পিছনে আগের জায়গায় বাঁধটি স্থানান্তরিত করা দরকার।”
গ্রামের আরেক কৃষক অরুণ দাস বলেন, “আমরা এখনো ২০-৩০টি ঘর কোনোমতে গ্রামে টিকে আছি। কিন্তু রাতে ঘুমাতে পারি না। যে কোনো সময় বসতঘর ভেঙে যেতে পারে। আমাদের যাবার জায়গা নাই। সরকার যদি আমাদের রক্ষা করে তাহলে গ্রামে পূর্বপুরুষের স্মৃতি নিয়ে থাকতে পারবো। না হলে এই গ্রাম ছেড়েই চলে যেতে হবে আমাদের।”
গ্রামের বৃদ্ধা আরতি রানী দাস বলেন, “এই গ্রাম ঘিরে অনেক স্মৃতি। আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামটি চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বসতভিটার সঙ্গে মুছে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য। আমার ঘর গত বছর ভেঙে গেছে। আমি চৌধুরী বাড়ির পরিত্যক্ত কাচারি ঘরে আশ্রয় নিয়েছি পরিবার নিয়ে।”
কিছু লোক পার্শ্ববর্তী গ্রামের পাশে নতুন গ্রামের জন্য জমি কিনলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে যেতে পারছেন না বলে জানান আরতি রানী।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহসভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “আমি একাধিকবার জয়পুর গ্রামে গেছি। নদীটিও মরে গেছে। কিন্তু বাঁধের কারণে কোর (গভীর গর্ত) তৈরি হয়ে গ্রামটিকে বিলীন করে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এখানে হাওরের ফসলরক্ষার টাকায় বাঁধ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এই বাঁধের চারদিকেই তারের মতো উদগল হাওরের বাঁধ আছে। তাই এই বাঁধ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু এই অপ্রয়োজনীয় বাঁধকে পুঁজি করে অর্থ হাতানোর পাশাপাশি একটি গ্রামের ইতিহাস মুছে দেওয়া হচ্ছে। অবিলম্বে এখানে প্রকল্প বন্ধ করে গ্রামরক্ষায় প্রকল্প নিতে হবে।”