“আমরা গুচ্ছতে এতদিন থাকায় সিস্টেমগুলো আপডেট করা হয়নি। সার্ভারের ক্যাপাসিটি কতটুকু এটাও আমরা জানতে পারিনি।”
Published : 18 Mar 2025, 09:50 AM
নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একক ভর্তি পরীক্ষার যাত্রা। গুচ্ছ থেকে বের হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষার আয়োজন করাতে কিছু সমস্যা হওয়ার কথা কর্তৃপক্ষও স্বীকারও করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বজায় রাখার জন্য গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এলেও সে উদ্দেশ্য কতটা সফল হচ্ছে- তা নিয়ে প্রশ্ন আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রের মান ক্ষুণ্ন হওয়া, ইংরেজিতে প্রশ্ন অনুবাদে ভুল করা, প্রশ্নের মান অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় দেওয়া, সার্কুলার প্রকাশের সময় থেকে পরীক্ষার হলে ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকা, বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রথম দুই দিন ওয়েব সার্ভার ডাউন থাকা, পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘অতিরিক্ত’ ফি নেওয়া, হটলাইন নম্বরে ভর্তিচ্ছুদের সাড়া না দেওয়া এবং আবেদনের পর তাদের অ্যাকাডেমিক তথ্য ওয়েবসাইটে ভুলভাবে প্রদর্শনসহ নানা অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ ওঠেছে ভর্তি কমিটির বিরুদ্ধে।
২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হয়। রোজার ছুটি শেষে ভর্তির কাজ শুরু হবে।
‘বি’ ইউনিটের বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে রসায়ন বিষয়ে বাংলা ভার্সনে একটি প্রশ্নের অর্থ ইংরেজি অনুবাদে বিপরীত অর্থ বোঝাচ্ছে। অথচ বাংলা ভার্সনের এবং ইংরেজি ভার্সনের ওই একই প্রশ্নে একই অপশন দেখাচ্ছে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাকিল বলেন, “ভর্তি পরীক্ষার আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখলাম শাবিপ্রবি অধ্যাপকরা গুচ্ছের প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানে দেখলাম শিক্ষকদের ভাষ্য ছিল, তারা শিক্ষার্থীদের শাবিপ্রবির প্রশ্নপত্রের প্যাটার্ন অনুযায়ী ও স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্নে শিক্ষার্থীর কোয়ালিটি যাচাই করতে পারছেন না। এজন্য তারা ভালো শিক্ষার্থীও পাচ্ছেন না।
“কিন্তু এবারের একক ভর্তি পরীক্ষায় আমার মত সাধারণ শিক্ষার্থী তো প্রশ্নের আহামরি কোনো ভিন্নতা দেখলাম না। বরং গুচ্ছ যে মানের প্রশ্ন করে সে মানেরই প্রশ্ন হয়েছে।”
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ইকবাল হোসেন বলেন, “আবেদনের সার্কুলারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা যাবে, সে বিষয় স্পষ্ট করেনি। আমার এলাকার অনেক শিক্ষার্থী শাবিপ্রবির বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার্থী ছিল। শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী হিসেবে তারা আমাকে ক্যালকুলেটরের ব্যবহারবিধি বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি স্পষ্ট কিছু বলতে পারিনি। পরবর্তীতে পরীক্ষার দুই দিন আগে কর্তৃপক্ষ ক্যালকুলেটর ব্যবহারের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।
“ভর্তি পরীক্ষা কমিটির এ ধরনের অব্যবস্থাপনা যেমন শিক্ষার্থীদের দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে, তেমনি ক্যালকুলেটর ছাড়া গাণিতিক সমস্যার সমাধানেও তাদের অতিরিক্ত সময় নষ্ট করতে হয়েছে।”
ভর্তির আবেদনের সার্কুলার দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সার্ভার ডাউন থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অনেক শিক্ষার্থী আবেদনই করতে পারেননি। সার্কুলার দেওয়ার আগে সার্ভার ঠিক আছে কিনা তা দেখা হয়নি কেন- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আরিফ বলেন, “৫ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পরীক্ষার আবেদনের সার্কুলার দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম দুদিন আবেদনের ওয়েব সার্ভার ডাউন থাকায় শিক্ষার্থীরা আবেদনই করতে পারেনি।”
তিনি বলেন, “আবেদনের জন্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের থেকে আবেদন ফি নিয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা করে। এত টাকা ফি নেওয়ার পরেও যদি প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে পরীক্ষার আয়োজন করত, তাহলে কিছুটা মানা যেত। বরিশাল ও রাজশাহীর মত এত বড় বিভাগে তারা কোনো কেন্দ্রই রাখেনি।”
এদিকে অনেক ভর্তি পরীক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক তথ্য ওয়েবাসাইটে ভুলভাবে প্রদর্শন করার অভিযোগ ওঠেছে।
শাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া ময়মনসিংহ জেলার নৌশিন মাহবুবা লামিয়া নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, “আবেদনের পর থেকেই পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগের দিন পর্যন্ত ওয়েবসাইটে আমার মাধ্যমিকের ফলাফল ও বোর্ড ভুল দেখায়। এ কারণে আমাকে দুঃশ্চিন্তা পোহাতে হয়েছে।”
ভর্তি পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে হটলাইন নম্বরে ফোন দিলে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি বলেও ভর্তিচ্ছুদের অভিযোগ।
কুমিল্লা জেলার লিমন হাসান নামে এক অভিভাবক বলেন, “আমার ছোট বোন শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষার্থী ছিল। আবেদনের পর ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র উত্তোলনের জন্য সে পাসওয়ার্ড ও ইউজার নেইম হারিয়ে ফেলে। এ সমস্যা সমাধানে ভর্তি পরীক্ষার হটলাইনে বেশ কয়েকবার কল দিলে তিন দিন পর তাদের রেসপন্স মেলে।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ মো. আতিকুল হক বলেন, “শাবিপ্রবির আগের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বেশিরভাগ ছিল প্রায়োগিক, টেকনিক্যাল ও সৃজনশীল। এ ছাড়া প্রতিটি প্রশ্নে পাঁচটি অপশন থাকত বলে পরীক্ষার্থীদের সময়ও অতিরিক্ত দেওয়া হত।
“মোট কথা শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র খুবই মানসম্পন্ন ছিল। কিন্তু ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার দুয়েকটা প্রশ্ন ছাড়া পুরো প্রশ্নপত্রকে আমি ভালো মানের বলতে পারব না। এ প্রশ্নে আমি সৃজনশীল বা প্রায়োগিকের কোনো ছাপ দেখেনি।”
তিনি বলেন, “শাবিপ্রবি তার স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য গুচ্ছ থেকে বের হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু এবারের প্রশ্নপত্রের কোয়ালিটিসহ যেসব জায়গা অসঙ্গতি ঘটেছে, তার মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয় সব শিক্ষকের সঙ্গে ভর্তি কমিটি ও প্রশাসনের সংহতি, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাব। তারা পুরো ভর্তি প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকদের খুব একটা সমন্বয় ও জড়িত রাখেনি। প্রশাসন যদি দলমত নির্বিশেষে আগামীতে সবার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে, তাহলে সব অব্যস্থপনা দূর করে আগের মত স্ট্যান্ডার্ড ভর্তি প্রক্রিয়া আয়োজন করা সম্ভব।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা ৮০টি প্রশ্ন হয়েছে। ৮০টি প্রশ্ন সমাধানে সময় দেওয়া হয়েছে ৯০ মিনিট। যেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একই মানের প্রশ্নে ১০০টি প্রশ্ন সমাধানে সময় দেয় ৬০ মিনিট, সেখানে শাবিপ্রবির এবারের প্রশ্নগুলোর মান অনুযায়ী ৯০ মিনিটি সময় দেওয়াকে অযৌক্তিক বলছেন শিক্ষকদের কেউ কেউ।
পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক খালিদুর রহমান বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের প্রশ্নের প্যাটার্ন ধরে রাখতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা এত সময় দিয়েছে বলে আমার মনে হয়। কিন্ত প্রশ্নের কোয়ালিটি দেখে আমার কাছে এত সময় দেওয়া অতিরিক্ত মনে হয়েছে।”
তিনি বলেন, “টানা চার বছর গুচ্ছে থাকার কারণে শাবিপ্রবি প্রশ্নের কোয়ালিটির এ অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে।”
দীর্ঘদিন একটা সিস্টেম থেকে দূরে থাকলে এমন বিচ্যুতি হওয়াটা স্বাভাবিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের তথ্য ভুল প্রদর্শনের বিষয়ে টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ মাসুম বলেন, “টেলিটক কর্তৃপক্ষ আমাদের যে তথ্য দিয়েছিল, সে তথ্যই ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে সব তথ্য আপডেট করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।”
ভর্তি কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “গুচ্ছের আগে একক ভর্তি পরীক্ষায় আমরা ৯০ মিনিটের পরীক্ষা নিতাম। এবারের প্রশ্নে ইন্টারমিডিয়েট, প্রিলিমিনারি ও অ্যাডভান্সড লেভেলের প্রশ্ন করা হয়েছে। অ্যাডভান্সড লেভেলের প্রশ্নগুলো পরীক্ষার্থীরা যাতে চিন্তা করে উত্তর করতে পারে, সেজন্য এ সময়টা দেওয়া হয়েছে।”
প্রশ্নের অনুবাদে ভুল হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “ইংলিশ ভার্সনে যে একটি প্রশ্নের অনুবাদ ভুল হয়েছে, সে প্রশ্নের মার্কটা আমরা সবাইকে দিয়ে দিয়েছি।”
শিক্ষকদের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “ভর্তি প্রক্রিয়া কিন্ত পুরোটা গোপনীয় বিষয়। যাদেরকে বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে তাদেরকে আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। আর ভর্তি কমিটির সবাই কিন্তু দক্ষ না। কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ না হলেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
“গুচ্ছ থেকে বের হয়ে পরীক্ষার আয়োজন করাটার সময়টা কিন্তু অনেক কম ছিল। এ সময়ের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে আনাও একটা বিষয় ছিল।”
সার্বিক বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সাজেদুল করিম বলেন, “বিজ্ঞান ইউনিটের জন্য ৮০টি প্রশ্নে ৯০ মিনিটি দেওয়া আমার মনে হয় ঠিক আছে। কিন্তু মানবিক ইউনিটের জন্য হয়ত সময়টা একটু বেশি হয়ে গেছে। আমরা গুচ্ছ থেকে সবে বের হয়ছি। আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
সার্ভার ডাউন থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা গুচ্ছতে এতদিন থাকায় সিস্টেমগুলো আপডেট করা হয়নি। সার্ভারের ক্যাপাসিটি কতটুকু এটাও আমরা জানতে পারিনি। এজন্য সার্ভারে সমস্যাটা হয়েছিল।”
অতিরিক্ত আবেদনের ফি নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিভাগীয় শহরগুলোতে পরীক্ষার আয়োজন করাতে ফি বেশি নিতে হয়েছে। তবু এবার তো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় লস করবে। ফি ১৫০০ টাকা করে নিলে হইত ঠিক হত।”