দক্ষিণ আফ্রিকায় নিহত: ৪ লাশ এসেছে, একজনের দাফন ওই দেশে

আবুল হোসেনের ছেলে নাদিম হোসেন জন্মগতভাবে আফ্রিকার নাগরিক হওয়ায় তার মরদেহ সেখানে দাফন করা হয়েছে।

নাজমুল হক শামীম, ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2023, 04:31 PM
Updated : 2 March 2023, 04:31 PM

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছয় জনের মধ্যে চার জনের মরদেহ দেশে এসেছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চার জনের মরদেহ স্বজনরা গ্রহণ করেছেন।

দুর্ঘটনার সাত দিন পর এই চার প্রবাসী বাংলাদেশির মরদেহ দেশে এলো।  

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসী এক বাংলাদেশি দেশে ফেরার সময় তাকে নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে গত ২৪ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় জন নিহত হন এবং একজন আহত হন।

যাদের মরদেহ দেশে এসেছে তারা হলেন ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের শরীয়ত উল্লাহর ছেলে ইসমাইল হোসেন (৩৮),  দাগনভূঞার মাতুভূঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের মিলনের নতুন বাড়ির আব্দুল মান্নান মিলনের ছেলে দ্বীন মোহাম্মদ রাজু (৩৪), একই উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের দক্ষিণ নেওয়াজপুর তমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া বাড়ির সিরাজ উল্লাহর ছেলে মোস্তফা কামাল পুপেল (৪০), সোনাগাজী উপজেলার চর মজলিশপুর গ্রামের জামাল হোসেনের ছেলে আবুল হোসেন (৩৫)।

ওই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের রামানন্দপুর গ্রামের বাহার মিয়ার ছেলে আনিসুল হক মিলন (৩৮) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার [২৭ ফেব্রুয়ারি] রাতে মারা গেলেও তার মরদেহ বৃহস্পতিবার দেশে এসে পৌঁছেনি বলে ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানান। 

এ ছাড়া নিহত আবুল হোসেনের ছেলে নাদিম হোসেন জন্মগতভাবে আফ্রিকার নাগরিক হওয়ায় তার মরদেহ সে দেশে দাফন করা হয়েছে।

ওই দুর্ঘটনায় আহত নাহিদ আহমেদের (৩৫) বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। গুরুতর আহত হয়ে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের শরীয়ত উল্লাহর ছেলে ইসমাইল হোসেনের মরদেহ বৃহস্পতিবার রাতে বুঝে নিয়েছেন তার ছোট ভাই মো. নিজাম উদ্দিন।

তিনি জানান, শুক্রবার সকাল ১০টায় তাদের বাড়ির দরজায় নামাজের জানাজা শেষে তার ভাইয়ের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

ইসমাইলের বাবা শরীয়ত উল্লাহ বলেন, “প্রায় ১০ বছর ধরে ইসমাইল দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করছিল। তার এক ভাইকে নিয়ে সেখানে সে একটি দোকান পরিচালনা করে আসছিল। দুই মাস পরে আমার ছেলের দেশে আসার কথা ছিল।

“পরিবারের সবাই সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। দেশে ফিরলে তাকে বিয়ে করাব। তার জন্য পাত্রী দেখা হয়েছিল। তার বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ছেলে মারা যাওয়ায় পরিবার ভেঙে পড়েছে। বাড়ির লোকজন সকলে শোকে বিহবল।”

সোনাগাজীর চর মজলিশপুরের জামাল হোসেনের ছেলে আবুল হোসেনের মরদেহ বুঝে নিয়েছেন আবুল হোসেনের বাবা জামাল হোসেন। তার সঙ্গে আবুল হোসেনের মামা মো. রহমত উল্লাহও উপস্থিত ছিলেন।

রহমত উল্লাহ জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় আবুল হোসেনের বাড়ির দরজায় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

তিনি বলেন, আবুল হোসেনের ছেলে আফ্রিকার জন্মগত নাগরিক নাদিম হোসেনের মরদেহ সেদেশে জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে।

আবুল হোসেনের বাবা জামাল হোসেন বলেন, তার তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল আবুল হোসেন। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল আবুল হোসেনের কাঁধে। আবুল হোসেন ১৩ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন। সেখানে স্থানীয় এক নারীকে বিয়ে করলেও পরে বিচ্ছেদ হয়। তাদের একমাত্র সন্তান নাদিম হোসেনকে নিয়ে সেদেশে বসবাস করে আসছিলেন আবুল হোসেন। তিনি নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাতেন। তার টাকায় দেশে পাকা বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে।

জামাল হোসেন আরও বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ছেলে আর দেশে আসেনি। হঠাৎ করে বলল আমার নাতিকে নিয়ে দেশে আসবে। আমার ছেলের আর আসা হলো না। আমার নাতির মুখও দেখতে পারলাম না।”

দাগনভূঞার মোমারিজপুরের আব্দুল মান্নান মিলনের ছেলে দ্বীন মোহাম্মদ রাজুর মরদেহ বিমানবন্দর থেকে বুঝে নিয়েছেন বাবা আব্দুল মান্নান মিলন। এ সময় রাজুর ছোট ভাই সাজু আহমেদও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

রাজুর চাচাত ভাই আব্দুল আউয়াল নাজমুল বলেন, রাজু আহম্মদের জানাজা মাতুভূঞার করিমউল্যাহ হাইস্কুল মাঠে শুক্রবার সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে।

রাজুর স্বজনদের বরাতে স্থানীয় মাতুভূঞা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন বলেন, আগামী ঈদের সময় বাড়ি ফেরার কথা ছিল রাজুর। মৃত্যুর আগের দিনও রাজু তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কার জন্য কী নিয়ে আসবেন। স্বজনদের জন্য এরই মধ্যে কিছু কেনাকাটাও করেছেন।

দাগনভূঞার দক্ষিণ নেওয়াজপুরের সিরাজ উল্লাহর ছেলে মোস্তফা কামাল পুপেলের মরদেহ বুঝে নিয়েছেন তার ছোট ভাই মোস্তফা জামাল নওফেল।

মোস্তফা জামাল নওফেল জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় নিজেদের বাড়ির দরজায় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

মোস্তফা জামাল আরও বলেন, কামাল ১২ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছিলেন। এক ছেলের জনক মোস্তফা কামাল সম্প্রতি ফোন করে বাড়িতে জানিয়েছিলেন, আগামী ঈদের সময় বাড়ি ফেরার জন্য চেষ্টা করবেন।

“পরিবারকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। এক দুর্ঘটনায় তার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।”

দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত দাগনভূঞার রামানন্দপুরের বাহার মিয়ার ছেলে আনিসুল হক মিলন চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাতে মারা যান।

মিলনের ছোট ভাই সাইদুল হক রিমন বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১৩ বছর পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার দেশে আসার কথা ছিল মিলনের। সোমবার সন্ধ্যায় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর আসে। পারিবারিকভাবে ১০ দিন আগে ভাইয়ের সঙ্গে খালাত বোন শাহেদা আক্তারের বিয়ে হয়। দেশে আসার পর ১০-১৫ দিনের মধ্যে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নববধূকে ঘরে তুলে নেবেন – এমনটাই কথা ছিল।”

মিলনের বাবা বাহার মিয়া বলেন, “আমার ছেলে দুই মাস আগে আফ্রিকায় নতুন ব্যবসা চালু করেছে; সে জন্য ব্র্যাক ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা লোন নিয়ে তার কাছে পাঠিয়েছি। এখন আমি ছেলে হারিয়ে ধারদেনা হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। কীভাবে পরিশোধ করব এই টাকা?” 

মিলনের ছোট ভাই সাইদুল হক রিমন আরও বলেন, দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, মিলনের মরদেহ শুক্রবার বিকালে দেশে আসার কথা রয়েছে। শুক্রবার লাশ দেশে আসলে শনিবার নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে বাংলাদেশে আসার জন্য জোহানেসবার্গ বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন আনিসুল হক মিলন। তাকে এগিয়ে দিতে একটি প্রাইভেটকারে চার বন্ধু ও বন্ধুর ছেলেকে নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে লরির সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে পাঁচজন এবং তিনদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিলন মারা যান।

ওই দুর্ঘটনায় আরেকজন আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফেনী জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা নিহতদের বাড়ি গিয়েছেন। তাদের স্বজনদের খোঁজখবর নেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার কথা ছিল ইসমাইলের, চলছিল বিয়ের প্রস্তুতি  

দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্ঘটনা: বউয়ের মুখ দেখা হলো না মিলনের