মায়ের ইফতার নিয়ে ফেরা হল না সুমনের, হল না বিয়েও

“আমার জন্য ইফতারি আনতে গিয়া ছেলেটা আর ঘরেই আইল না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচমু,” কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন মা।

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2023, 10:51 AM
Updated : 9 March 2023, 10:51 AM

বছর তিনেক আগে কাতারে পাড়ি জমিয়ে সংসারের ভাগ্যের চাকা ঘোরান সুমন, স্বচ্ছ্বলতা আসায় দশ দিন আগে দেশে ফিরেই বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করেন; কিন্তু সোমবার বিকালে মায়ের জন্য ইফতার আনতে গিয়েই ওলোট-পালোট হয়ে গেছে সবকিছু।

২১ বছরের এই তরুণ সোমবার পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে গিয়েছিলেন ইফতার আনতে। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলে অন্যদের মত তিনিও ছিটকে পড়েন সড়কে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার রক্তাক্ত নিথর দেহ শনাক্ত করেন তার বাবা।

পাঁচজনের সংসার সামলানো একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে যেন শোকে পাথর গোটা পরিবার; আচমকা কোনো ঢেউ এসে যেন ভেসে নিয়ে গেছে তাদের সব স্বপ্ন।

সুমনের পরিবার থাকে সিদ্দিকবাজারের পাশে সুরিটোলা এলাকায়। শবে বরাত উপলক্ষে তার মা রোজা রেখেছিলেন বলে বিকালে ইফতার আনতে বের হয়েছিলেন তিনি।

তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিয়াভাঙ্গা ইউনিয়নে। দুই যুগ আগে মেঘনা নদীগর্ভে তাদের বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে গেলে তার মা-বাবা চলে আসেন ঢাকায়। স্থায়ী হন সিদ্দিকবাজারের সুরিটোলা এলাকায়।

সুমনের বাবা মোহাম্মদ মমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতে গিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করাতে পারিনি। ছোট থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করতে সে। সাড়ে তিন বছর আগে ভাগ্য বদলাতে কাতারে যায়। পুরো পরিবারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে।”

তিনি জানান, চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে সুমন বড়। তার আয়ে সংসারের অভাব কেটে সুখের আলোর দেখা মিলছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হল না বেশি সময়।

“গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন সুমন। বিয়ে করবে তাই সোমবার গেণ্ডারিয়া এলাকায় মেয়েও দেখতে যাই আমরা। মেয়ে পছন্দও হয়েছে। বুধবার সব ঠিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই সব শেষ হয়ে গেল।”

মমিন বলেন, “মঙ্গলবার দুপুরে আমার সঙ্গে খেয়েছে সুমন। বিকালের দিকে বলল- আব্বা তুমি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার করতে যাও। আমি মায়ের জন্য ইফতার আনতে যাই।

“একসঙ্গে বাবা-ছেলে বের হলাম। সে গেল সিদ্দিকবাজার, আমি অন্য বাজারে। একটু পরেই খবর পাই সেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে আর এতে আমার ছেলেও আহত হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, একসঙ্গে ঘর থেকে বের হওয়া আমার ছেলেটা ঢাকা মেডিকেলের ফ্লোরে পড়ে আছে। ডাক্তার বলল- আমার ছেলে নাকি মারা গেছে। ইফতারি না এনেই মারা গেল ছেলেটা।”

সুমনের মা তাজু বেগম বলেন, “ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কষ্ট করে সংসারের হাল ধরেছিল সুমন। তাকে নিয়ে আমাদের কতই না স্বপ্ন ছিল। ছেলেটা বলত- মা আমি বিদেশে ভালো আছি। তোমাদের আর কোনো কষ্ট হবে না। এখন থেকে সংসারের সবাই সুখে থাকবে।

“ভাবিনি এই সুখ শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমার জন্য ইফতারি আনতে গিয়া ছেলেটা আর ঘরেই আইল না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচমু।”

কুমিল্লার চালিয়াভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, “সুমনের মৃত্যুর খবরের পর থেকেই মনে অস্থিরতা কাজ করছে। তাদের সারাজীবনই গেল কষ্টে। ছোট এক ছেলে রয়েছে। অনেক কষ্টে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে, আরেকটা মেয়ে আছে।

“ছেলেটার মৃত্যুর পরে কল দিয়েছি। মমিন পাগলের মত ডুকরে কাঁদছিল। স্থানীয় কয়েকজনকে বলেছি সহায়তা করতে। তার ঘর নিয়ে গেল নদী আর বিস্ফোরণে গেল ছেলেটার জীবন।”

বুধবার ভোরে সুমনকে রাজধানীর আজিমপুর করবস্থানে দাফন করা হয়।

সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত সুমনসহ মোট ২১ জনের প্রাণ গেছে। বিস্ফোরণে আহত ২৭ জন এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আটজনের অবস্থাও ভালো নয়।

আরও পড়ুন-

Also Read: সিদ্দিক বাজারের ভবনে আরেক লাশ, মৃত্যু বেড়ে ২১

Also Read: সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ: নিখোঁজ স্বপনের খোঁজে ফায়ার সার্ভিস

Also Read: চুড়িহাট্টা থেকে সিদ্দিক বাজার: ঝুঁকি জেনেও উদাসীন সবাই

Also Read: সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণ: আহত একজনের মৃত্যুতে মৃত্যু বেড়ে ২০

Also Read: সিদ্দিক বাজারের ভবনটির এখন কী হবে?