ভাঙচুর করা হয়েছে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বাসভবন, দুদক অফিস, শিশু পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
Published : 04 Aug 2024, 05:44 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগের প্রথম দিনে বরিশালে পাল্টাপাল্টি হামলা, ধাওয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
রোববার বেলা ১১টা থেকে শুরু হওয়া দুই পক্ষের সংঘর্ষে পিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। আহত হয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন শিশু ও কিশোরসহ অর্ধশতাধিক লোক।
ভাঙচুর করা হয়েছে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বাসভবনে, দুদক অফিস, শিশু পার্ক, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা। অ্যাম্বুলেন্সহ বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক মোটরসাইকেল।
এছাড়াও বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে ভাংচুর করে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
নিহত মো. টুটুল চৌধুরীকে (৬০) বরিশাল নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ৯টা থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সদর রোড বিবি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। তাদের হাতে আগ্নেয় ও ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা দেখা গেছে।
পরে তারা বিভক্ত হয়ে নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। তারা শিক্ষার্থী দেখলেই হামলা ও মারধর করেন। এক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নগরের চৌমাথা এলাকায় অবস্থান নেন।
এদিকে বেলা ১১টার দিকে বিএম কলেজ এলাকায় জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ নেওয়ারা। তারা মিছিল নিয়ে নগরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও মারধরের খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা নগরের চৌমাথা এলাকায় রওনা হয়। সেখানে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। শিক্ষার্থীরা পাল্টা ধাওয়া দিলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পিছু হটে যায়।
ধাওয়া খেয়ে একদল নেতাকর্মী নগরের নবগ্রাম রোড এলাকায় পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও সদর আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত জাহিদ ফারুক শামীমের বাসভবন বেগম ভিলায় আশ্রয় নেয়। তখন আন্দোলনকারীরা একজোট হয়ে বাসভবনে হামলা করে।
এ সময় ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় পড়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা টুটুল চৌধুরীকে বেধড়কভাবে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখে আন্দোলনকারীরা। পরে তাকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক এএসএএম সায়েম মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের পরিবার দাবি করেছে, টুটুল চৌধুরীর লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও শর্টগান ছিল। সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।
আরও জানা গেছে, হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা এলাকায় অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পিছনে পুলিশ ছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নথুল্লাবাদ থেকে আসা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ কারণে বিক্ষুদ্ধ হয়ে বিক্ষোভকারীরা পাল্টা হামলা করে।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী মাহিদুর রহমান মাহাদ বলেন, “হামলাকারীরা মন্ত্রীর বাসার সামনে দেড় থেকে দুই শতাধিক মোটরসাইকেল ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পরে মন্ত্রীর বাসভবনের নিচ তলায় তাণ্ডব চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে। ”
মন্ত্রীর বাসায় হামলা চালিয়ে বিক্ষোভকারীরা নগরীর নবগ্রাম রোড বটতলা এলাকায় দুদক অফিসে ভাঙচুর করেছে। এ সময় সেখানে আলেকান্দা পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলার চেষ্টা করা হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা হামলা ভাঙচুর শেষে হাতেম আলী কলেজের সামনে ও চৌমাথা এলাকায় অবস্থান নেয়। চৌমাথা লেকের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম শিশু পার্ক তছনছ করে তারা।
এদিকে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নগরের সদর রোড অশ্বিনী কুমার হলের পাশে বিএনপি কার্যালয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ৫০/৬০ জন লোক বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে রাখা এক পুলিশ সদস্য ও আরেক ব্যবসায়ীর মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। পরে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে ভাংচুর করে অগ্নিসংযোগ করেছে। হামলাকারীরা অশ্বিনী কুমার হলের জানালার গ্লাসও ভাঙচুর করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, বিএনপি অফিসের পাশে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবাই আতংকিত হয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। কিন্তু তারা কেউ আসেনি। বাধ্য হয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আগুন নিভিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে বিক্ষোভকারীরা। সেইসাথে নথুল্লাবাদ থেকে চৌমাথা পর্যন্ত সড়কের বেশ কয়েকজায়গাতে অ্যাম্বুলেন্সহ বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পাশাপাশি এই সড়কের পাশে থাকা ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ কয়েক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে।
নগরের চৌমাথা এলাকায় ৬টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা। সেইসাথে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ প্রাঙ্গনে থাকা একটি টিনের ঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে।
এছাড়া বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে থাকা বরিশাল জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরতরা বিকাল ৩টা পর্যন্ত জানিয়েছে, আহত হয়ে এক শিশু, কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী অর্ধশতাধিক আহত ভর্তি হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরের নথুল্লাবাদ থেকে হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা হয়ে বটতলা পর্যন্ত তাণ্ডব চলেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠিসোটা। একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সশ্রস্ত্র অবস্থায় নগরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবিরের কাছে মোবাইল করে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরে জানানো হবে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম মোবাইলে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।