মাদারীপুর-৩ আসনে নির্বাচনি সহিংসতায় একজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে; হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে অনেকগুলো।
Published : 05 Jan 2024, 08:55 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকেই যে কয়টি আসন বার বার আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে মাদারীপুর-৩ আসনটি অন্যতম।
এ আসনে নির্বাচনি সহিংসতায় একজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে; হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে অনেকগুলো।
এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান মিয়া গোলাপ। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় এই প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের বিরুদ্ধে এবার ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন; ভোটে লড়ছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে।
দুইজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার কালকিনিতে নির্বাচনি জনসভা করে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। এরপর আগের চেয়ে বেশি চাঙ্গা দেখা যাচ্ছে নৌকা প্রতীকের অনুসারীদের।
তবে প্রধানমন্ত্রী সেদিন সরাসরি স্বতন্ত্র প্রার্থী সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। এজন্য ঈগল প্রতীকের সমর্থকরা প্রচার চালাচ্ছেন, শেখ হাসিনাও চান এখানে লড়াই হোক। তারাও শেষ কয়েকদিনে তাদের প্রচার বেগবান করেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান পাশের মাদারীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। কিন্তু মাদারীপুর-৩ আসনের সদরের অংশে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি এখানে প্রচারেও এসেছেন গোলাপের পক্ষে। তার ছেলেও গোলাপের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন।
কালকিনি ও সদর উপজেলা এবং ডাসার থানা আওয়ামী লীগ নেতারা এখানে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে তাহমিনার পক্ষেই বেশি নেতাদের দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদারীপুর-২ ও মাদারীপুর-৩ আসনের নেতাকর্মীরা মূলত দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী। এই দুই নেতাকে কেন্দ্র করেই মাদারীপুরের এই দুটি আসনের রাজনীতি পরিচালিত হয়।
কালকিনি ও সদর উপজেলার একাংশ এবং ডাসার থানা নিয়ে গঠিত এই আসনে ২০১৪ সালে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নাছিম। কিন্তু ২০১৮ সালে আবদুস সোবহান গোলাপকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি সংসদ সদস্য হলেও তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেননি বলে দলেরই একাংশ মনে করেন। যার ফলে এবারের নির্বাচনে তাকে শক্ত প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
সরজমিনে দুই প্রার্থীর প্রচার
বুধবার মাদারীপুর-৩ আসনের নির্বাচনি এলাকা হাজিরহাওলায় গণসংযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগম। তিনি ঘটমাঝি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক করেন। পরে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর জনসভা কালকিনি হওয়ায় আমাদের অবস্থান আরও ভালো হয়েছে। নৌকার জনসভা শেষে সাধারণ মানুষ বের হয়েছে ঈগলের মিছিল নিয়ে। জনগণ একজন দুর্নীতিবাজ এমপির অবসান চায়। নির্বাচনের মাঠে নামার আগে আমি ভাবতেও পারিনি গোলাপ সাহেবের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এত মানুষ কথা বলবে। আমার পাশে এসে দাঁড়াবেন।”
“আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই ঈগল মার্কার পক্ষে। সুষ্ঠু ভোট হলে আমার জয় নিশ্চিত”, যোগ করেন তাহমিনা বেগম।
অপরদিকে বিকালে সদর উপজেলার খোয়াজপুর এলাকায় গণসংযোগ করেন আবদুস সোবহান গোলাপ। স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে প্রচার চালান তিনি। তার নির্বাচনি এলাকায় গত ইউপি নির্বাচনে যেসব চেয়ারম্যান নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়েছেন তাদের অধিকাংশকেই প্রচারে দেখা গেছে।
তিনি বলেন, “যে যাই বলুক মাদারীপুর-৩ আসন নৌকার ঘাঁটি। আমার প্রতিপক্ষকে স্বতন্ত্র মনে করি না। তিনি আওয়ামী লীগের লোক হয়ে, আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের এমপি হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন।
“কাজেই তিনি স্বতন্ত্র নয়। তিনি একজন বিদ্রোহী প্রার্থী, যা জনগণ ভালো চোখে নেয়নি। তারা আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। যা সত্য নয়।”
জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান খান রুবেল বলেন, “এখানে নৌকার বিরুদ্ধে কেউ নয়। মাদারীপুরের সিংহভাগ মানুষ আওয়ামী লীগ পছন্দ করে। এই আসনের নির্বাচন নৌকার বিরুদ্ধে নয়। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান।
“যেহেতু নেত্রী দলীয় লোকজনকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। তাই আমরা যোগ্য মানুষের পক্ষে কাজ করছি।”
কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন সরদার বলেন, “কালকিনিতে নৌকার সমর্থক বেশি। এখানে সবসময়ই নৌকা পাস করে এসেছে। আমরা দলগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গোলাপের জন্য কাজ করছি। মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। নৌকা এখানে পাস করবে এটা নিশ্চিত। কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না।”
এখানে মোট ছয়জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাকি চারজন হলেন- জাতীয় পার্টির আব্দুল খালেক (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির প্রবীণ হালদার (সোনালী আঁশ), কৃষক শ্রমিক জনতা দলের নুকুল চন্দ্র বিশ্বাস (গামছা) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির নিতাই চক্রবর্তী (একতারা)।
তবে এই চার প্রার্থীর প্রচার তেমন চোখে পড়েনি।
এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৭০ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৮ জন। হিজড়া ভোটার রয়েছে তিনজন।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালে জয় পান আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম।
২০১৮ সালে জয়লাভ করেন আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ।
ভোটারদের কথা
বুধবার বিকালে খোয়াজপুরের পুরনো ফেরিঘাট এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
তারা বলছিলেন, মাদারীপুর-৩ আসনের মধ্যে পড়লেও এখানে শাজাহান খানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তার সমর্থক প্রচুর।
ভোটাররা এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে সেটা বিবেচনায় না নিয়ে শাজাহান খানের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। যেহেতু তিনি নৌকার প্রার্থী গোলাপকে সমর্থন দিয়েছেন, ফলে সেই ভোট সেদিকেই যাবে। এখানে নৌকা প্রচুর ভোটই পাবে, বলছেন অনেকে।
তবে তাহমিনা বেগমও খুব বেশি পিছিয়ে থাকবেন না- এমনটাও বলেন কেউ কেউ।
খোয়াজপুর বাজারে চা-পান বিক্রেতা আইয়ুব আলীর দোকানে ৬০ বছর বয়সী ভ্যানচালক সবুর আলী বেপারী বলেন, “আমরা এই এলাকায় সবাই নৌকার লোক। কিন্তু নৌকার মাঝিরে তো পাঁচ বছরে একবারও আমাগো এইখানে আইতে দ্যাহি নাই। তাই এলাকার দ্যাহি বারো আনা লোকই ঈগলের। নৌকার মাঝির লোক পাই না।”
সায়মন আহমেদ নামে একজন তরুণ ভোটার বলেন, “শাজাহান খান যেহেতু গোলাপকে সাপোর্ট দিয়েছেন, তাই নৌকায় তিনি এখানে বেশ ভোট পাবেন। শাজাহান খান যদি তাকে সাপোর্ট না করতেন তাহলে এই এলাকায় তার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না।”
একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভোটার বলছিলেন, “নৌকার ভোট আছে। কিন্তু তারা চুপ মেরে আছে। যারা সারাজীবন নৌকায় ভোট দিছে তারা এবারও নৌকাতেই ভোট দিব।”
আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাদশা মোল্লা বলেন, “গতবার তো আর নির্বাচন হয় নাই। এহন আর নৌকা বুঝি না। যে ভালো প্রার্থী মোরা তারেই ভোট দেব। যারে সহজে পাওয়া যাবে।”
কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুজ্জামান শাহিন ও ডাসার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিদুৎ কান্তি বাড়ৈ স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনার পক্ষে কাজ করছেন।
তারা বলছিলেন, তাহমিনা পাঁচ দশক ধরে কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত সৈনিক। তাকে ভোট দিলে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেওয়া হবে।