“এই গুড় খাইনে আমরা। গুড়ের ওপরে টিকটিকি, ইদুর মরে থাহে। এসব দেহে কি এতা খাওয়া যায়?।”
Published : 06 Apr 2025, 01:30 PM
গুড় তৈরির পর শৌচাগারের পাশে টিন ও মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে। খোলা সেই পাত্রে ধুলোবালি পড়ছে। চারপাশে ভন ভন করে উড়ছে মাছি-পোকামাকড়।
এ চিত্র রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের হুলাইল গ্রামের একটি গুড় কারখানার।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি ও পাংশা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভেজাল গুড়ের কারখানা। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভারতের এলসি গুড়, পানি, চিনি সঙ্গে আখের পচা গুড়, রঙ, সোডা, ফিটকিরি ও কেমিকেল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘আখের গুড়’।
দেখতে ঝকঝকে এসব গুড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যেই। পাশাপাশি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি এসব গুড় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ গুড় খেলে হতে পারে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে মরণব্যাধি ক্যান্সার বিভিন্ন জটিল রোগ।
যদিও প্রশাসনের দাবি, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধে ‘নিয়মিত’ অভিযান চালিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়াসহ অসাধু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের চরঝিকড়ি গ্রামে পাশাপাশি নামবিহীন দুটি ভেজাল গুড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে আখ মাড়াইয়ের মেশিন থাকলেও আখের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি। কারখানার চারপাশে কয়েক’শ গুড় রাখার মাটির পাত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
দুটি কারখান সামনেই গুড় তৈরির জন্য চুলা রয়েছে। তার ওপরে রাখা একটি বড় কড়াইয়ে কিছু গুড় লেগে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল, কয়েক ঘণ্টা আগেই তাতে গুড় তৈরি করা হয়েছে। সেই কড়াইয়ে বিভিন্ন পোকামাকড় ঘুরে বেড়াচ্ছে সদর্পে। বাইরে উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখা হয়েছে টিনজাত পচা গুড় ও নিম্নমানের চিনি। তাতে উঁকি মারতেই ভেতরে টিকটিকিসহ মরা পোকামাকড় পড়ে থাকতে দেখা গেল।
কারখানা দুটির দরজায় তালা মারা থাকলেও বাইরে কয়েকজন শ্রমিক চিনির টিন গোছানোর কাজ করছিলেন। কিন্তু তারা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
চরঝিকড়ি গ্রামের বাসিন্দা চামেলি খাতুন বলছিলেন, “এহুন গুড় দিনে বানায় না, রাতি (রাতে) বানায়। কাজ শেষ করে ফজরের আজানের পরপরই কারখানায় তালা দিয়ে চলে যায়।”
কি কি উপরকরণ দিয়ে গুড় তৈরি করে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা মাজে-মদ্দি (মাঝে মাঝে) আসি দেহি, চুলার মদ্দি থেহে গুড় কড়াইত জ্বাল দেয়। তারপর টিনির (টিনের পাত্র) থাহা চেনি দেয়। পরে রঙ আর কি কি যেন দেয়।
“তবে এই গুড় খাইনে আমরা। পচা গুড়। গুড়ির ওপরে টিকটিকি, ইদুর মরে থাহে। এসব দেহে কি এতা খাওয়া যায়?।”
ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা রহিম মেল্লা বলেন, “কুশোর (আখ) নাই, কিন্তু মণ কে মণ আখের গুড় বানায়। বিভিন্ন জাগারতেন পচা গুড় কিনে আনে তার সঙ্গে রঙ, চিনি, ফিটকেরি মিশায়ে গুড় বানায়। তারা গুড় বানায় রাত্রিরে। আবার ফজরের আজানের পরপরই কারখানা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়।”
বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের হুলাইল গ্রামের গুড় কারখানায় কথা হয় মালিক মো. বিল্লালের সঙ্গে।
গুড় কিভাবে বানান প্রশ্নে তিনি বেশ সাবলীল কণ্ঠে উত্তর দেন। বলেন, “প্রথমে গুড় কড়াইয়ে রেখে চুলায় তাপ দেওয়া হয়। বেশ কিছু সময় তাপ দেওয়ার পর কালো হয়ে আসলে মেশানো হয় ভারত থেকে আসা টিনজাত চিনি। এরপর গুড় ঢেলে বিভিন্ন পাত্রে রাখা হয়। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ মণ গুড় তৈরি করা হয়। এসব গুড় বাজারজাত করা হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।”
তাদের তৈরি গুড় স্বাস্থ্যসম্মত কি-না জানতে চাইলে বিল্লাল আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলেন, “অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত। পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশেই আমাদের গুড় তৈরি হয়। অনেক সাংবাদিক এসে গুড়ের নমুনাও পরীক্ষা করেছেন। তারা বলেছেন, গুড়টা ভালো। এমনকি প্রশাসনের লোকজন এসেও ঘুরে দেখে গেছেন। খারপ কিছু তৈরি করি না বলেই তো এখনও জরিমানা করে নাই।”
নোংরা পরিবেশের গুড় কেনো তৈরি করেন জানতে চাইলে ওই কারখানার শ্রমিক আব্দুল আওয়াল বলেন, “খোলা জায়গায় যদি একটা জিনিস তৈরি করা হয় তাহলে সেখানে মশা-মাছি আসবেই। এখন এটা ভালো না খারাপ কিভাবে বলবো?”
গুড়ে রঙ-কেমিকেল মেশানার প্রসঙ্গ টানতেই তিনি উত্তর দেন, “আর কিছু বলতে পারব না।”
মো. নাসিরউদ্দিন নামের আরেক শ্রমিক বলেন, “ভারতের এলসি দিয়ে গুড় দিয়ে আখের গুড় তৈরি করা হয়। ফলে এই গুড়টা দানাদার হয়; দেখতেও ভালো দেখায়। যে কারণে গুড়টা মানেও ভালো, মিষ্টিটাও ভালো।”
কারখানায় ‘ভালো মানের’ গুড় তৈরি হয় দাবি করে নাসিরউদ্দিন বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে কারখানা চালাচ্ছে মালিক। যদি ভেজাল গুড় হতো তা এতদিনে পুলিশ-প্রশাসন এসে কারখানা বন্ধ করে দিতো।”
এ বিষয়ে জানতে জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সূর্য্য কুমার প্রামানিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
পরে পাংশা উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মো. তৈয়বুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “রোজার আগে আমরা উপজেলার একটি গুড় কারখানায় গিয়েছিলাম। সেখানকার গুড়ের নমুনা নিয়ে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যে ফলাফল পেয়ে যাবো। এরপর বোঝা যাবে গুড়ে ক্ষতিকারক কিছু আছে কি-না।”
“কারখানাগুলোতে অভিযানের বিষয়ে সাবেক সহকারি কমিশনার ভূমি রুবেল স্যারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি বদলি হওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। বর্তমান সহকারি কমিশনার (ভূমি) স্যারের সাথে কথা হয়েছে। ঈদের ছুটি শেষ হলেই অভিযান চালানো হবে।”
এসব যে প্রক্রিয়ায় গুড় তৈরি হচ্ছে, তা স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলে তৈয়বুর মনে করেন। তিনি বলছেন, “গুড় আর চিনি এক না। গুড় কারখানার মালিকরা জানিয়েছেন, গুড়ে চিনি মেশালে গুড় শক্ত হয় সে কারণে তারা চিনি মেশান। তবে রঙ মেশান না বলে দাবি তাদের। আমরা কারখানা মালিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি, গুড়ে কোনো কেমিকেল বা রঙ মেশানো যাবে না।”
চিনি, রঙ ও কেমিকেল দিয়ে তৈরি এসব গুড় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্নক ক্ষতি করে বলে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ হান্নান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এসব বিষাক্ত খাবারে কিডনি আর লিভার বেশি আক্রান্ত হয়। আর আমরা যেহেতু মুখ দিয়ে খাই, মুখে ঘাও হতে পারে; এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। এজন্য এসব খাবর খাওয়ার আগে সবাইকে সচেতন হতে হবে।”
ভেলার গুড় তৈরির প্রসঙ্গে পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম আবু দারদা বলেন, পাংশা উপজেলায় হাবাসপুর ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি কারখানায় নোংরা পরিবেশে, কেমিকেল মিশ্রিত ভেজাল গুড় উৎপাদন করে। আমরা বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। এছাড়া ভোক্তা অধিকারেও মামলা করা হয়েছে এবং পুলিশকেও বলা হয়েছে ওখানে টহল রাখতে।
প্রশাসনের অভিযানের পরও এসব কারখানা বহাল তবিয়তে রয়েছে কি করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে আসি, ভেঙে দিয়ে আসি; তারপর তাদের আটক করে জেল-জরিমানাও করা হয়। ওরা পরে আবার নতুন ভাবে নতুন ‘ইস্টাইলে’ শুরু করে।”
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ইসলামপুর ইউনিয়নের হুলাইল গ্রামে একটি গুড়ের কারখানার খবর আমরা পেয়েছি। সেখানে দ্রুত অভিযান চালানো হবে।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজবাড়ী জেলার সহকারী পরিচালক কাজী রকিবুল হাসান বলেন, “আমরা পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে ভেজাল গুড়ের কারখানায় অভিযান পরিচালনা করে মালিকদের জরিমানা করেছি। স্থানীয় প্রশাসন কারখানা বন্ধও করে দিয়েছে। পরে দেখা গেল, স্থান পরিবর্তন করে আবারও শুরু করেছে। বালিয়াকান্দি উপজেলার কারখার বিষয়টি শুনেছি। সেখানেও দ্রুতই অভিযান চালানো হবে।”