উজানে পানি কমলেও হাওরের বাঁধগুলো ঝুঁকিতে

সুনামগঞ্জের উজানের নদ-নদীতে পানি কিছুটা কমলেও ভাটির নদীগুলোতে পাহাড়ি ঢলের চাপে ঝুঁকির মুখে রয়েছে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো; যা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক।   

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2022, 07:54 AM
Updated : 6 April 2022, 08:12 AM

মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার তিনটি বাঁধ ভেঙে প্রায় ২২৫ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ওই তিনটি বাঁধের মধ্যে শাল্লা উপজেলার দুটি তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিইসি) কাজের বাইরে।

ধর্মপাশা উপজেলার বাঁধটি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। ওই এলাকায় পরিদর্শনে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে কৃষকরা প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন।  

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ে বা তৎসংলগ্ন সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল আছে।

“সুনামগঞ্জের প্রধান নদ সুরমাসহ সীমান্ত নদী যাদুকাটা, চলতি, পাটলাই নদীর পানি অল্প কমছে। কিন্তু এই পানি পুরাতন সুরমাসহ হাওরের ভাটির নদ-নদীতে মিশে চাপ সৃষ্টি করায় সেসব নদীতে পানি বাড়ছে। যার ফলে দিরাই, শাল্লা, ধর্মপাশাসহ বিভিন্ন উপজেলার ফসল রক্ষা বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাহাড়ি ঢলের ধাক্কা এসব অস্থায়ী বাঁধ সামলাতে পারছে না। তবে প্রশাসন ও পাউবো এসব বাঁধে প্রকল্পের লোকজনসহ স্থানীয় কৃষকদেরকেও স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।

জেলায় বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আলাদা কোনো কার্যালয় নেই। মূলত পাউবো কার্যালয় এ সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে থাকে।

পাউবোর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, বুধবার দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। আর যাদুকাটা নদীর পানি ৯১ সেন্টিমিটার এবং পুরাতন সুরমা ১৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছিল।

জহুরুল ইসলাম বলেন, “পাহাড়ি ঢলে কাচা বাঁধগুলোর নিচ দিয়ে ছোট ছোট গর্ত, যা চোরাই লিক হিসেবে পরিচিত, সেগুলো ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষকদের নিয়ে সবগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধেই পিআইসির লোকজনকে তদারকিতে রেখেছি। কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছি।”

তিন দিনে ৭ হাওরে তলিয়েছে ৫০০ হেক্টর জমি

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার সোম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার তাল হাওরের ডুবাইল বাঁধ ভেঙে ১৮৫ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে। একই সময়ে শাল্লা উপজেলার কৈয়াবন ও পুটিয়া হাওরের ৪০ হেক্টর জমি পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে।

“গত তিন দিনে চারটি উপজেলার সাতটি হাওরের প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে।”

তিনি বলেন, নদ-নদীর পানি হাওরের সবগুলো বাঁধে চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে ঝুঁকিতে আছে বাঁধগুলো।

“যে কোনো সময় অন্যান্য হাওরের ফসলও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান এখনও কাটার উপযুক্ত না থাকায় কাঁচা ধান কৃষক কাটতে পারছেন না।”

চন্দ্রসোনার তাল হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশের খবর পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেখানে ছুটে যান সিলেট বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোশাররফ হোসেন, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

এ সময় ক্ষুব্ধ কৃষকরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) অনিয়মের ফলে ডুবাইল বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবেছে বলে অভিযোগ করেন। তখন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন কৃষকদের সামনেই তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন।

জেলা বাঁধ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক কৃষকদের বলেন, যাদের কর্তব্যে অবহেলার কারণে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর সঙ্গে সরকারি লোক জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে লিখা হবে।

“পিআইসির অবহেলায় বাঁধ ভাঙা প্রমাণিত হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করব।”

চন্দ্রসোনার তাল হাওর পাড়ের বাসিন্দা ও সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোক্তার মিয়া বলেন, “ডুবাইল বাঁধে বড় ক্লোজার ছিল। যারা কাজটি এনেছে তারা ঘুষ দিয়ে কাজ এনেছে। পরে বিলের সময়ও তাদের কাছ থেকে কমিশন রাখা হয়েছে। যে কারণে তারা ভালো কাজ করতে পারেনি। এ কারণে মঙ্গলবার বাঁধটি ভেঙে আমাদের সর্বনাশ ঘটেছে।”

তিনি আরও বলেন, “পাশের হাওরের বাঁধগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে রাতদিন কাজ করছি। জানি না কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারব।”

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, “গতকাল মঙ্গলবার শাল্লায় দুটি হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানি হয়েছে। এগুলো পাউবোর কোনো প্রকল্পভুক্ত নয়। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পাহাড়ি ঢল প্রবেশ করে ওই দুটি হাওরের ফসল ডুবেছে।”

প্রকল্পভুক্ত চন্দ্রসোনার তাল হাওরের ডুবাইল বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি বলেন, জেলা বাঁধ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: