নজরদারিতে হাওরের বাঁধ, স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ

সুনামগঞ্জের পাহাড়ি ঢলের ধাক্কা থেকে হাওরের একমাত্র ফসল রক্ষায় বাঁধগুলোকে শক্তিশালী করতে গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে; পাশাপাশি বাঁধের তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি জানতে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।  

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিশামস শামীম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2022, 07:44 AM
Updated : 4 April 2022, 03:42 PM

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে সোমবার জানানো হয়েছে, গত তিন দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৩৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টিপাত ১০০ মিলিমিটার হওয়ার কথা ছিল। রোববার পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে প্রায় ৫৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ফলে সীমান্তবর্তী সব নদ-নদীতে ঢল নেমেছে।

পাউবোর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার বছরের মধ্যে এই সময়ে এত বেশি পাহাড়ি ঢল নামেনি। ৩১ মার্চ রাত থেকে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত ৫৪৫ মিলিমিটার রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই পানি এসে নামছে সুনামগঞ্জে। যার ফলে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন হাওরের ফসল ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থানে থেকে কাজ করছি।”

তিনি সোমবার আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত পাউবোর প্রকল্পভুক্ত কোনো বাঁধ ভাঙেনি। তবে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেগুলো আমরা পিআইসির লোকজন দিয়েও সারিয়ে নিয়েছি। আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পাহাড়ি ঢলের চাপ থাকতে পারে।”

তাহিরপুর উপজেলার বৌলাই নদীতে ঢলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রোববার থেকে গোপিনাথ নোয়াগাঁও, নিশ্চিন্তপুর, লতিফপুরসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা শনি, মহালিয়া, মাটিয়ান হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্বেচ্ছায় বাঁধে কাজ করছেন।

এই তথ্য জানিয়ে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল এখনও কাঁচা। এই অবস্থায় পাহাড়ি ঢলের চোখ রাঙানির মুখে থাকা কৃষক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ফসল মার গেলে হাহাকার ওঠে হাওরে। প্রতিটি হাওরের কৃষকই এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।”

শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবু তালেব বলেন, হাওরের বাঁধ ঠিক রাখতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কাজ হচ্ছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে পর্যবেক্ষক দল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। বাঁধগুলোর পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। 

শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, পাহাড়ি নদী যাদুকাটা, পাটলাই নদীর পানি সুরমা ও পুরান সুরমা নদীসহ অন্যান্য শাখা নদী হয়ে এখন দিরাই-শাল্লা উপজেলার হাওরগুলোতেও চাপ সৃষ্টি করেছে।

“উপজেলার জোয়াইর হাওর, ভানুবিল হাওর, খৈয়ার হাওর, পুটিয়ার হাওরের প্রকল্প বহির্ভূত বাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। বাঁধ উপচে এসব হাওরে রোববার বিকেল থেকে পানি ঢুকতে দেখা গেছে। এই অবস্থা দেখে অস্থির কৃষকরা সকাল থেকেই বিভিন্ন পয়েন্টে উড়া-কোদাল নিয়ে কাজ করছেন।”

চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, “পাউবো এসব পয়েন্টকে বাদ দিয়ে অক্ষত একাধিক প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ দিয়ে অর্থ অপচয় ও লোপাট করেছে। অনেক কৃষক লিখিত অভিযোগও করেছিলেন।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাওরের বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল। অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে গণশুনানি করে প্রকল্প গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু কোথাও গণশুনানি হয়নি। অভিজ্ঞ কৃষকদের মতামত নেওয়া হয়নি।

“অনেক অক্ষত প্রকল্পকে বিক্ষত দেখিয়ে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় ও লোপাট করা হয়েছে। যদি নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ করা যেত তাহলে পাহাড়ি ঢলের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলানো যেত।”

চিত্তরঞ্জন তালুকদার আরও বলেন, “শুধু অপরিকল্পিত বাঁধ দিলেই হবে না। মূল কাজ হচ্ছে, নদী খনন করতে হবে। হাওরে তারের মতো জড়ানো নদী-খালগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা হলে পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা নদী-খালগুলো সামলাতে পারত।

“কিন্তু আমাদের এখানে প্রতি বছর শত কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দিয়ে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এসব বাঁধ পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে নানা প্রতিঘাত করছে। যার ফলে প্রতিটি হাওরের বাঁধে পাহাড়ি ঢল বিপুল শক্তি নিয়ে আঘাত করছে।”

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের ৭২৭টি পিআইসির সংশ্লিষ্টসহ প্রতিটি উপজেলার কর্মকর্তা ও বাঁধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে। আমরাও বাঁধগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছি।“

আরও পড়ুন: