বিশাল হাওর বিস্তৃত সাত জেলা নিয়ে। এর মধ্যে নেত্রকোণায় হাওরাঞ্চলে এবার ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার কৃষক এই আবাদে যুক্ত।
এ জমির পুরোটাই এক ফসলি। পুরো হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় জেলায় প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা ডুবন্ত বাঁধ রয়েছে। বাঁধ তলিয়ে গেলে মানুষের দুর্দশার সীমা-পরসীমা থাকে না। তাই বাঁধ নিয়ে শঙ্কা বোরো ফসল না তোলা পর্যন্ত কাটে না কৃষকের।
“গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাঁধ সংস্কারকাজে হাত দেয় পাউবো। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মাটি কাটার কাজ সম্পন্নের পাশাপাশি বেশিরভাগ বাঁধের পাশে ঘাস ও গাছ লাগানোর কাজও শেষ করা হয়। যেসব স্থানে ঘাস লাগানো বাকি ছিল তাও পরে শেষ করা হয়েছে।”
নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি, “এবার সময়মতো বাঁধ সংস্কার হওয়ায় মাটি শক্ত অবস্থানে আছে। আগাম বন্যা হলেও পানির তোড়ে ভাঙবে না। আশা করছি, বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটলে কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।“
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এফ এম মোবারক আলী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা নিয়মিতই হাওরে যাচ্ছি, ফসলের গোছা দেখছি। বাঁধের কাজ করেছে পাউবো। এই প্রথম মনে হয়, এই অংশে ভাল কাজ হয়েছে।”
“বৈশাখের সাধারণ ঢলে হয়তো কিছু হবে না। তবে ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢলে আগাম বন্যা হলে ভিন্ন বিষয়। কাজের মান ভাল মনে হইছে। কৃষকরাও বলছে, তাদের বাড়ির সামনের বাঁধের কাজ ভাল হইছে। তাদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা এবার কম মনে হইছে”, বলেন উপ-পরিচালক।
ইসমাইল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে বেক (প্রতি) বছরেই বান্দের (বাঁধ) কাম ধরত দেরিতে। চৈত মাসে বান্দের কাম ধরত। বানে মাটি বইত না। শক্ত অইত না। মাটি নরমই থাকত। আগাম বন্যাডা আইলে পানির তোরে বান ভাইঙা ফালাইত। এইবার মেলা আগে বান্দের কাম ধরছে। রাইতে-দিনে কাম করছে।
“চৈত মাসের শুরুতেই বানের কাম শেষ কইরালাইছে। এইবার বানটা শক্ত। মাটি বইতাছে। আগাম বানে (বন্যা) কিছু আইত না। বড় ধরনের বান অইলে আরেক কথা। তাইলে আমরার কপাল খারাপ। না আইলে আমরার সমস্যা আইত না। এইবার হাওরের ধান লইয়া চিন্তা কম আছে।”
নূর মিয়ার ভাষায়, “আমরার এই বোরো ফসলডাই সম্বল। আর কুনু ফসল করনের বাও নাই। এই ফসলডার ওপরেই আমরার জীবন। সারা বছরের সংসার খরচ চালাই এই বোরো ফসলডা দিয়াই। অন্যান্য বছরগুলাত যে লাগাত ধান কাইট্যা ঘরে না আনছি, হেই লাগাত ফসল লইয়া দুঃশ্চিন্তায় ঘুমাইতে পারছি না। এইবার ফসল রক্ষা বান তাড়াতাড়ি ঠিক কইর্যালাইছে।
“ধান ক্ষেত কী সুন্দর অইছে। যেইহান দিয়াই চাইবাইন খালি খেত। হবুজ (সবুজ) আর হবুজ।“
কৃষক জাকির হোসেন বলেন, “দেহেন জীবন বাজি রাইখ্যা ফসলডা করি। ঋণ-ফিন কইর্যা ধান লাগাই। আর এই ফসলডা বানে (বন্যা) চোখের সামনে নিয়া গেলে আমরা বাঁচি কেমনে! আগে কোনোবছরই সময়মতো কাম আইছে না, দেরিতে করছে, আমরার কামে আইছে না।
“বন্যার পানি আইয়া ঠেলা মাইরা বান (বাঁধ) ভাইঙ্গা লইয়া গেছেগা। হাওরকে হাওরের জমি ডুবাইলছে। এইবারই পয়লা বান্দের কাম এতো তাড়াতাড়ি অইছে। মাটিটাও শক্ত অইয়া বইতাছে। আমরার চিন্তা কইম্যা গেছে।“
তিনি বলেন, “বাঁধের কাজ সময় মতো শেষ অইছে। এইবার আগাম বন্যা লইয়া অতোটা চিন্তা নাই। বছর বছরই যেন এইবারের মতোই বান্দের কাজ শেষ করে সরকারে। আগে তো বান্দের কামের অফিসারেরা কতো অজুহাত দিত। কইত পানি নামতে দেরি অইছে। মাটি কাটনের কামলা পায় না। এইরকম যেন আর না অয়।”
খালিয়াজুরী উপজেলার আদমপুর গ্রামের কৃষক আয়েন উদ্দিন বলেন, “এইবারের মতোই আগামীতেও যেন বান্দের কাম সময়মতোই শেষ কইর্যা দেয়।”
আরও পড়ুন