মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার খবর রাজাকাররা ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর পাকিস্তানি সেনারা কুমিল্লার সরাফত আলীর বাড়ি গিয়ে ব্রাশফায়ারে ৩৭ জনকে হত্যা করে।
Published : 09 Mar 2022, 09:20 AM
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয়। সেই গ্রামের বাসিন্দা সরাফত আলী। একাত্তরের যুদ্ধের সময়টাতে তিনি ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখান থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন।
সচ্ছল এই কৃষক পরিবারে গ্রামের কয়েকজন নারী এবং কৃষিশ্রমিক বাড়িতে কাজ করতেন। সবসময় নানা কাজে লোকজনের আনাগোনা থাকত। এই অবস্থার মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১১ অগাস্ট গ্রামের খন্দকার বাড়ির সরাফত আলীর উঠোনে দুপুরবেলা ব্রাশফায়ার চালায় পাকিস্তানি সেনারা।
ওই ঘটনার পর সরাফত আলীর পরিবারের কেউ আর জীবিত ছিলেন না। ফলে এ ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। শুধু এক মেয়ে বেঁচে ছিলেন অন্য গ্রামে বিয়ে হয়েছিল বলে। সরাফত আলীর মেজ মেয়ে মনুজা খাতুনের ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাশের মাঝিগাছা গ্রামে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেদিন স্বামীর বাড়ি ছিলেন; ফলে তিনি বেঁচে যান। মনুজা খাতুন খবর পেয়ে এসে দেখেন বাপের বাড়ির উঠোনজুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। সেই স্মৃতি নিয়েই তিনি সারাজীবন বেঁচে ছিলেন। মনুজা ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। মনুজার স্বামী আব্দুল হাকিম মারা গেছেন আরও আগে।
এখন মাঝিগাছা গ্রামের বাড়িতে মনুজার ছেলেদের সঙ্গে বড় মেয়ে হাসিনা আক্তারও থাকেন। সম্প্রতি সেই বাড়িতে গিয়ে ছেলেদের কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে ছিলেন হাসিনা আক্তার।
তার কাছেই সেই গণহত্যার কাহিনি শুনেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
হাসিনা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার নানা দেশ স্বাধীনের জন্য পেছন থেকে ভূমিকা রাখতে গিয়ে সব হারিয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর আগেও তিনি প্রায়ই এসব কথা বলতেন। আমার মা তার পরিবারের সবাইকে হারিয়ে সারাজীবন অনেক কষ্ট আর দুঃখে কাটিয়েছেন। সেদিন স্বামীর বাড়িতে থাকায় মা প্রাণে বেঁচে যান। না হলে ঘাতকরা আমার মাকেও মেরে ফেলত।”
হাসিনা আক্তার, গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সরাফত আলী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন – এটা রাজাকাররা কোনোভাবে জেনে ফেলে। তখন তারা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে খবর দেয়। ১১ অগাস্ট দুপুরবেলা গ্রামটির আশপাশে সেনা সদস্যরা আসতে শুরু করে।
তখন কৃষক সরাফত আলী শ্রমিকদের নিয়ে ক্ষেতে কাজ করছিলেন। সেদিন তার বাড়িতে সাতজন শ্রমিক ছিল। তিনি দুপুরে শ্রমিকদের নিয়ে বাড়ি এসে পুকুরে হাত-পা ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে খেতে বসেন। শ্রমিকরাও ঘরের বাইরে খেতে বসেছে। সুনসান দুপুরবেলা। এর মধ্যেই গ্রামে হানা দেয় হানাদার বাহিনী।
লোকজন পালাতে থাকে। কিছু লোক সরাফত আলীর বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের পিছু পিছু হানাদার বাহিনীও এসে উপস্থিত হয়। বাড়িতে ঢুকেই তারা ব্রাশফায়ার করা শুরু করে। যেখানে যাকে পেয়েছে গুলি করেছে নির্বিচারে। মুহূর্তে ৩৭টি লাশ পড়ে এক উঠোনে, রক্তে ভেসে যায় আঙ্নিা।
সরাফত আলীর নাতনি হাসিনা আক্তার বলেন, ৩৭ জনের সবার পরিচয় তখন জানা যায়নি। কারণ, কৃষিশ্রমিকরা গ্রামের বাইরের ছিলেন। আশ্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ চিনত না। ব্রাশফায়ারে অনেকের লাশ বিকৃত হয়ে যায়। ফলে সেদিন অনেকের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭১ সালে কৃষ্ণপুর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা হাজী মো. সেলিম ১০-১১ বছর বয়সী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানি সেনারা গ্রাম ছেড়ে গেলে তিনি খন্দকার বাড়িতে গিয়েছিলেন।
সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখন ছোট ছিলাম, তবে এখনও সব কিছু মনে আছে। সেদিন পাকিস্তানি হানাদাররা চলে যাওয়ার পরও আট মাসের দুধের শিশু সাজিদা খাতুন বেঁচে ছিল। শিশুটি লাশগুলোর উপর বেঁচে ছিল। ব্রাশফায়ারে শিশুটির নাড়িভুড়ি বের হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ওই রাতে শিশুটি মারা যায়।”
শিশুটির কথা বলেছেন গ্রামের বাসিন্দা জহিরুল হক খন্দকারও। সেই রাতে তিনি ৩৭ জনকে দাফনের কাজে অংশ নিয়েছিলেন।
খন্দকার বাড়ির সদস্য জহিরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণেই খন্দকার বাড়ির ওপর পাকিস্তানিদের নজর পড়েছিল। ঘটনার কয়েকদিন আগে আমরা কয়েকজন সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাই।
“বাড়ির ৩৭ জনকে হত্যার কথা শুনে সেদিন বিকালে আবার বাড়ি ফিরে আসি। এসে দেখি লাশগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তখনও পড়ে রয়েছে। খন্দকার বাড়ির প্রায় ১৫টি ঘর ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানিরা।”
জহিরুল আরও বলেন, “পরে স্থানীয়দের নিয়ে আমরা পাশাপাশি দুটি গর্ত করি। একটি গর্তের মধ্যে নারী এবং অপরটিতে পুরুষদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। এই ৩৭ জনের ভাগ্যে সেদিন গোসল কিংবা জানাজা কিছুই জোটেনি।”
তিনি বলেন, “দুঃখের বিষয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পার হলেও সরকারিভাবে ওই ৩৭ জনের গণকবরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। গণকবরের জায়গা অনেকে দখল করে ঘর তুলেছেন।“
সরাফত আলীর নাতনি হাসিনা আক্তার আফসোস করে বলেন, “সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, এখনও ৩৭ জনের ভাগ্যে জোটেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। আমার মা বিষয়টি নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আক্ষেপ করে গেছেন। আমরা কোনোকিছু চাই না, শুধু দেশের জন্য নিহত ওই ৩৭ জনের প্রাপ্য সম্মানটুকু চাই।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. সফিউল আলম বাবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যাচাই-বাছাই করে ওই গণকবরটি সংরক্ষণের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। গণকবরটি সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে ওই সম্পত্তি কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই গণকবরটি সংরক্ষণের কাজ শুরু হবে।”
কৃষ্ণপুর গ্রামের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা হাজী মো. সেলিম বলেন, “আমরা চাই, দ্রুত এই গণকবরটি সংরক্ষণে সরকার উদ্যোগ নিক। বলতে গেলে আশ্বাস ছাড়া কিছুই জোটেনি এখনও।”
কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গ্রামের বাসিন্দা সামছুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, “প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস এলেই এই গণকবরের খোঁজ নেয় অনেকে। এরপর আবার ভুলে যায় সবাই। গণকবরটি সংরক্ষণের পাশাপাশি এ ঘটনার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন।”
কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গ্রামের যুবক মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, “গণকবরটি ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে আমরা গ্রামের যুকবরা মিলে এটি পরিষ্কার করি। এরপর বিজয় দিবসে গণশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমরা চাই, সরকারি উদ্যোগে দ্রুত এটি সংরক্ষণ করা হোক। না হলে নতুন প্রজন্ম এই গণশহীদদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না।”