নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলের মাঠজুড়ে দুলছে কাঁচা-পাকা ধান। যেদিকে চোখ যায় শুধুই ধান আর ধান। আর দিন দশেকের মধ্যে আগাম জাতের ফসল কাটা শুরু হবে। এটি কাটা হতে না হতেই ব্রি-২৯ ও অন্য জাতের কাটার সময় হয়ে যাবে। এখনই মাঠে মাঠে বোরোর সোনালী আভার সঙ্গে বাতাসে ছড়াচ্ছে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ।
Published : 09 Apr 2020, 12:36 AM
হাওরপাড়ের কৃষকের মুখে এখন হাসির ঝিলিক। এবারের ফলনও ভালো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদিত ফসল কৃষকের গোলায় উঠবে বলে আশা করছেন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, নেত্রকোণায় বোরো আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী উপজেলা ছাড়াও কলমাকান্দা ও আটপাড়ার একাংশ নিয়ে হাওর এলাকায় এবার আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমি। ব্রি-২৮, ব্রি-২৯সহ নানা জাতের ধান আবাদ করেছেন কৃষকেরা। হাওরে চার থেকে পাঁচ মাস পানি থাকায় সেখানে একটি বোরো ফসলই আবাদ হয়। বর্ষায় হাওরের জমিতে পলি পড়ায় উর্বরা শক্তি বেশি। এ কারণে সেখানে এই এক বোরো ফসলের ফলন সাধারণত ভালো হয়। তবে ঝুঁকিও বেশি। বিশেষ করে আগাম বন্যার হানা বেশি। বন্যার দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষায় হাওরে বাঁধ রয়েছে। তবুও এই বাঁধে সবসময় ফসল রক্ষা করতে পারে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হাওর পাড়ের কৃষকরা জানিয়েছেন, মাঠে আগাম জাতের ব্রি-২৮ (চিকন চাল) ধান পাকতে শুরু করেছে। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে কাটা শুরু হবে।
হাওরে এবারের আড়াই লাখ মেট্রিক টনসহ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পুরোটাই অর্জিত হবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশা করছে।
“আমি ১৫ একর জমি চাষ করেছি। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি কাঠায় পাঁচ থেকে সাত মন ধান হবে। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হয় তাহলে আমরা ধান গোলায় তুলতে পারব বলে আশা করছি। এই ধানগুলা আমাদের নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও বাইরে দেশে বিক্রি করতে পারব।”
এবার ভালো ফলন হওয়ায় নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধানের যোগান দেওয়ার আশার কথা বললেন চাষি শুভ সরকার।
তিনি বলেন, “বিগত বছরের চেয়ে এবার ভালো ফলন হয়েছে। আমরা চিকন যে ব্রি আর ২৮ ধান সেটা কাঠা প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মন ধান পাব। তবে কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রাস না করে তাহলে আমরা খুব ভালোভাবে ফসল তুলতে পারব। আমাদের চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা যোগান দিতে পারব।”
তিনি বলেন, “২৮ যে ধানটা সেটা আমরা ১০/১২ দিনের মধ্যে কাটতে পারব। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যের কোনো সমস্যা হবে না।”
জালালপুর গ্রামের কৃষক আমির উদ্দিন ফসল নিয়ে আলাপচারিতায় বলেন, “রোয়াটোয়া ভালোই হয়েছে। সারটার দিলাম ভালোই। এই তারিখে ধানও ভাল হইতাছে। আশা করি আল্লাহ ভালো দেউখ। ১০/১২ দিনের ভিতরেই কাটা পড়ব।”
ফলনের ভাল লÿনের কথা জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান বলছেন, কৃষকেরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি জেলার খাদ্য মিটিয়ে উৎপাদিত বাড়তি ধান দেশের অন্য জেলাগুলোতে সরবরাহ করা যাবে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমাদের নেত্রকোণা জেলায় এবছর ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। হাওর এলাকায় ৪০ হাজার প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হইছে। হাওর এলাকার ফসলের অবস্থা খুবই ভালো। আমরা আশা করতেছি কৃষকেরা একর প্রতি ৬০ থেকে ৭০ মন ফলন পাবে। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হয়, আমাদের চাহিদার চেয়ে ফলন বেশি হবে। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নেত্রকোণা জেলায় খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে (চাউলে) সাত লক্ষ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। আশা করতেছি বেশি হবে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দিনে গড়ে প্রতিজনে ৪৫৪ দশমিক ৬ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এতে নেত্রকোণা জেলায় ২৩ লাখ মানুষের বিপরীতে বছরে খাদ্যের প্রয়োজন হয় ৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টনের মতো। আর জেলায় আমন, বোরো আর আউশ মিলিয়ে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। গত আমন আর আউশের উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। দপ্তরটির হিসাব অনুযায়ী এবার বোরো ধান কোনোরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে যে ফসল গোলায় উঠবে তাতে করে ৭ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন ধান উদ্বৃত্ত থাকবে।
বাড়তি ধানের বিষয়ে উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত খাদ্যটা যেখানে ঘাটতি আছে সেখানে দেয়ার সুযোগ পাব।”
দেশজুড়ে আবাদ ও লক্ষ্যমাত্রা
নেত্রকোণা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, এবার জাতীয়ভাবে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে অর্জিত হয় ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪০ হেক্টর জমি। এই জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন।