বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে দেশের নদনদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

জেলা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2019, 06:13 PM
Updated : 16 July 2019, 06:49 PM

যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে।

উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলেও পার্বত্য জেলা বান্দরবানে কিছুটা উন্নতির খবর পাওয়া গেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদ-

বগুড়া

বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় বাড়িঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যা দুর্গত অনেকে বাঁধে আশ্রয় না পেয়ে অন্য নিরাপদ স্থানের খোঁজে চলে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সারিয়াকান্দির শনপচা, মাঝিড়া, বোহাইুল, আওলাকান্দিচর ও ধুনটের বৈশাখীচরসহ অনান্য চরের অধিকাংশ স্থানেই পানি উঠেছে। হাজার মানুষ গবাদি পশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। একদিকে বন্যা অন্যদিকে বৃষ্টিতে এসব মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। খোলা জায়গায় রান্না করতে দেখা গেছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং-এ ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রায়হানা ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনে নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বন্যা হয়েছে। তিন উপজেলার ৫৫৪ গ্রামের মধ্যে ৯৮টি জলমগ্ন হয়ে ১৬ হাজার ৪৪০ পরিবারের ৬৬ হাজার ৮০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নদী ভাংগনে ১৪৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ২৪০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধে দুই হাজার ও অন্যান্য স্থানে ৪৯ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

তিনি আরও জানান, প্রকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ আট লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আরও ৩৫৮ মেট্রিক টন চাল চাল ও আট লাখ টাকা মজুদ আছে। দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পাবার পর উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিন উপজেলায় ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ অক্ষত রয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আছে। ইতিমধ্যে দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও ১৪২ মেট্রিক টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে।

“৫৯টি প্রাথমিক ও দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্যা কবলিত হয়েছে। বন্যার পানিতে মোট আট হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে পাট পাঁচ হাজার ১০ হেক্টর, আউস ধান তিন হাজার ৫০৫ হেক্টর, সবজি ৪০ হেক্টর, মরিচ নয় হেক্টর, আমন বীজতলা ৩৫ হেক্টর ও আখ চার হেক্টর জমি।”

সারিয়াকান্দি উপজেলার আট ইউনিয়নে দুই শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে বলে তিনি জানান।

গাইবান্ধা

জেলায় গত সোমবার পর্যন্ত চারটি বাঁধে ভাঙনের কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিরি আরও অবনতি ঘটেছে। ধসে পড়া এলাকা দিয়ে সোমবার রাত থেকে গাইবান্ধা শহরে বন্যার পানি ঢুকে কুঠিপাড়া, পূর্বপাড়া, জুম্মাপাড়া, সবুজপাড়া, মুন্সিপাড়া, নিউ ব্রিজ পাড়া, বানিয়ারজান, ব্রিজরোড কালিবাড়ীপাড়া ও  ডেভিট কোম্পানিপাড়া প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফলে এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

অপরদিকে ঘাঘট নদীর শহর রক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গাইবান্ধা শহরবাসী ভাঙন আতঙ্কে র্নিঘুম রাত কাটাচ্ছে। বাঁধটির ডেভিট কোম্পানীপাড়া এলাকায় যে কোনো মুহূর্তে পানি উপচে পড়ার আশঙ্কাও করছেন শহরবাসী। এদিকে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের কারণে শুধু শহর নয় মঙ্গলবার আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে প্লাবিত আরও ৬টি ইউনিয়নসহ জেলার ৩২টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এসব এলাকায় সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও তীব্র  খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি খাদ্য সংকট পড়েছে গবাদি পশু পাখি।

শহরের ব্রিজরোড কালিবাড়ী পাড়ার বাসিন্দা সামসুজ্জোহা সেলিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলার কারণে শহররক্ষা বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট ধসে গেছে। হু-হু করে পানি ঢুকে শহরের বেশ কিছু এলাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে শহরবাসী।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, শুকনো মৌসুমে পাউবো বাঁধগুলো মেরামতে কোনো উদ্যোগ নেয় না। শুধু বন্যার সময় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে কোমড় বেঁধে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করে। কিন্তু গাইবান্ধাবাসী শেষ রক্ষা পায় না।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১৩৩ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৯০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে তিস্তার পানি সোমবারের চেয়ে ৩ সে.মি কমে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে।

বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

জেলা ত্রাণ কার্যালয় থেকে জানা যায়, গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, সাদুল্লাপুর, গোবিন্দগঞ্জ ও ফুলছড়ি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৬ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য ১১৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র একজন মানুষ মারা গেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এসএম ফেরদৌস জানান, বন্যায় চার হাজার ১৫২ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল দাইয়ান বলেন, জেলার বন্যা কবলিত এলাকার ১ হাজার ৯৫৫টি পুকুরের ৪৯৯ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে, যার মূল্য ৬৮৫ দশমিক ৯২ লাখ টাকা।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসেন আলী জানান, বন্যার পানি উঠায় জেলায় নতুন করে আরও ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান স্থগিত করা হয়েছে। এনিয়ে মোট ১৭৩টি বিদ্যালয়ে পাঠদান স্থগিত রয়েছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন জানান, পানি উঠে পড়ায় জেলার ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন আবু হানিফ জানান, জেলার ১০৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এ পর্যন্ত ডায়রিয়া কিংবা পানিবাহিত কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি।  

গাইবান্ধার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক রোখসানা বেগম বলেন, জেলায় ৪০০ মেট্রিক টন চাল এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; যা ইতোমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। নতুন করে আরও এক হাজার মেট্রিক টন চাল, দশ লাখ টাকা এবং পাঁচ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

নীলফামারী

নীলফামারীতে তিস্তার বন্যায় ডিমলা উপজেলায় ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাললে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গত বৃহস্পতিার তিস্তার পানি বিপৎসীমা অত্রিক্রম করলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত ও এসব বিদ্যালয় জলমগ্ন হয়ে পড়ে।

মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত নীলফামারীর ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েণ্টে নদীর পানি বিপৎসীমা বরাবর প্রবাহিত হওয়ায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি তিস্তাপারের বন্যা পরিস্থির। ফলে শুরু হয়নি এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যাপূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় তিস্তা ব্যরাজ পয়েণ্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা বরাবরে প্রবাহিত হয়। গত বৃহস্পতিবার ওই পয়েণ্টে নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে শনিবার সকালে বিপৎসীমার ৫০ সেণ্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর থেকে ধীরগতিতে কমছে তিস্তার ঢলের পানি। ওই পয়েণ্টে নদীর পানির বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেণ্টিমিটার।

ডিমলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দপ্তর জানায়, প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে উপজেলার ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জলমগ্ন রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকায় ঢলের পানি প্রবেশ করায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়িতে বানের পানি প্রবেশ করায় এলাকার লোকজন বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ায় এসব বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠদান বন্ধ আছে।

জেলা শিক্ষা কর্র্মকর্তা ওসমান গণি বলেন, প্রবল বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে সৃষ্ঠ বন্যায় ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত এলাকার ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িকভাবে স্থগিত আছে। বন্যার পানি সরে গেলে বিদ্যালয়গুলো সংস্কার করে দ্রুত পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হবে।

তবে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ নেই বলে জানান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।

বান্দরবান

বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টানা নয় দিন বৃষ্টির পর সোমবার থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীতে পানির স্তর নেমে গেছে।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও রেড ক্রিসেন্টের জেলা সাধারণ সম্পাদক একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে বন্যার পানি। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষজন ঘরে ফিরলেও শহরে বেশির ভাগ বন্যাকবলিত মানুষ এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে।

এদিকে লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মজনুর বলেন, মঙ্গলবার সকালে পৌরসভায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৭০০ পরিবারের মধ্যে সাতশ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭ ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত আরও ১ হাজার নয়শ পরিবারকে ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।

তবে স্থানীয়রা বলেন, বান্দরবান শহরের আর্মি পাড়া, শেরে বাংলা নগর, ইসলামপুর, ক্যচিংঘাটা, বালাঘাটা ও কালাঘাটার বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ও অন্যান্য স্থাপনা পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৫-৬ দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। টিউবওয়েল, রিংওয়েল ডুবে যাওয়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানিরও সংকট চলছে।

বালাঘটা ও কালাঘটার বাসিন্দা তারেকুল ইসলাম ও জন ত্রিপুরা অভিযোগ করেন, পাঁচ-ছয় দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। পৌর পানি সরবরাহ বন্ধ। টিউবওয়েল, রিংওয়েলগুলো ডুবে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাজারে তরিতরকারিসহ খাদ্যসামগ্রীর সংকট চলছে। যা আছে তাও দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সোহরাব হোসেন বলেন, শহরে বন্যাকবলিত এলাকায় ৩৫০টি জার সরবরাহ করা হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে আরও সরবরাহ করা হবে।

পরিবহন শ্রমিকরা জানান, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়ায় সড়ক ডুবে থাকায় বান্দরবানের সাথে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের যোগাযোগ এখনো চালু হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ধসে জেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সজীব আহমেদ বলেন, ভারি বৃষ্টি না হলে কাল মঙ্গলবার থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। তবে ধসে পড়া মাটি সরিয়ে রাস্তা সংস্কারের কারণে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি সড়ক চালু করতে আরও সময় লাগবে।

তবে মঙ্গলবার থেকে বিকল্প যাতায়াতের জন্য রুমায় নৌপথ চালু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শফিউল আলম বলেন, বান্দরবানের জন্য ৪৫০ মে. টন চাউল, সাড়ে ৭ লাখ নগদ টাকা, ৫শ তাঁবু, ২ হাজার ৫শ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ ছিল। এগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী বিতরণ করা হচ্ছে। এর বাইরেও গত এক সপ্তাহ ধরে খিচুড়ি রান্না করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র ও ধরলা নদীর পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি। ভাঙনের শিকার হয়েছে সহস্রাধিক পরিবার। রৌমারীতে বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

জেলায় দুদিনে বন্যার পানিতে ডুবে এক প্রতিবন্ধীসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে।

কুড়িগ্রাম ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারি পরিচালক মনজিল হক বলেন, উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের নতুন অনন্তপুর এলাকায় নৌকা ডুবে একই এলাকার রেজাউল ইসলামের স্ত্রী রুনা বেগম, মহসিন আলীর কন্যা রুপা মনি ও আয়নাল হকের ছেলে হাসিবুল ইসলামকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ সময় সুমন ও রুকু মনি নিখোঁজ থাকে। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহিনুর রহমান সরদার বলেন, রুপা মনি ও হাসিবুল ইসলাম নামে দুশিশুকে দুপুরে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসে। পরে তাদের পরিবারের লোকজন শিশু দুটিকে বাড়িতে নিয়ে গেছে।

জেলা কন্ট্রোল রুম জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত কুড়িগ্রামে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ভাঙনে ৪ হাজার ৫৩৬জন এবং পানিবন্দি ৩ লাখ ৯২ হাজার ২৭২ জন।

বন্যার ফলে পানিবন্দি মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও আশ্রয়ের সংকটে ভুগছেন তারা। চরাঞ্চলে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সারাদিন পানিতে চলাফেরা করায় বানভাসীরা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বেড়ে গিয়ে ১২৫ সে.মিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৯৫ সে.মি এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ১১৭ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার পানি কমে গিয়ে ১০ সে.মি নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

জেলার উলিপুর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন সাহেবের আলগার মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিক হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান।

এই ইউনিয়নে মোট ৫ হাজার ৩৭০টি পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ৩শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ১৪টি উচুঁ জায়গায় অবস্থান নিয়েছে ১৮শ’ পরিবারের লোকজন। এছাড়াও নৌকায় আশ্রয় নিয়েছে ৮শ’ পরিবার।

সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, এই ইউনিয়নের ৩৫ হাজার মানুষের মধ্যে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি এবং চারদিকে পানি ওঠায় লোকজন রান্নাবান্না করতে না পেরে এক প্রকার না খেয়ে রয়েছে। এছাড়াও দিন মজুর শ্রেণির লোকেরা কর্মসংকটের কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

জরুরি ভিত্তিতে তাদেরকে ত্রাণ সহায়তার কথা জানান তিনি।

উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, ঘরে ধান আছে কিন্তু ভাঙতে না পারায় খেতে পারছে না বানভাসিরা। এখানে জরুরি ভিত্তিতে শুকনো খাবার প্রয়োজন। এই ইউনিয়নের ২৪ হাজার মানুষের মধ্যে ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দি।

রৌমারীর যাচুর চর ইউনিয়নের কর্ত্তিমারী চাকতাবাড়ী এলাকায় সোমবার রাতে ওয়াপদা বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এখানে কর্ত্তিমারী মাস্টারপাড়ায় বাঁধের ৭০ ফুট অংশ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। এতে ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ যাদুরচর ডিগ্রি কলেজ, যাদুরচর মডেল কলেজ এবং এমএ হাকিম আইডয়াল মহিলা কলেজসহ ১০টি গ্রাম এখন পানির নিচে অবস্থান করছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন যাদুরচর ইউপি চেয়ারম্যান সরবেশ আলী। একই অবস্থা বিরাজ করছে পুরো জেলা জুড়ে।

কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, বন্যার্তদের সহায়তায় নতুন করে ৩ মে.টন চাল ও ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া বন্যার্তদের পাওয়া গেছে ৫০০ তাবু। জেলার ৪১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৯৮হাজার ৬৮টি। আর নদী ভাঙনে এ পর্যন্ত গৃহহীন হয়েছেন এক হাজার ১৩৪টি পরিবার।

জনস্বাস্থ্য বিভাগ ৮৩টি নলকুপ, ১৬৭টি ল্যাট্রিন স্থাপন করেছে। পানি বিশুদ্ধ ট্যাবলেট সরবরাহ করেছে ৪০হাজার ৬০০টি এবং ৭০০জেরিকেন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করেছে বলে তিনি জানান।

নেত্রকোণা

নেত্রকোণায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ৫ উপজেলার নিম্নাঞ্চল। এরই মধ্যে জেলায় ২২৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বন্যার্ত, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমেশ্বরী, কংশ, উব্ধাখালি, ধনুর পানি বেড়েই চলেছে। এতে করে জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টার পাশাপাশি নতুন করে নেত্রকোণা সদর, পুর্বধলা, আটপাড়া, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

পানিবন্দি ৪ শতাধিক গ্রামে আছেন লক্ষাধিক মানুষ।

ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন,  এ পর্যন্ত বরাদ্দের ৫০ মেট্রিক টন চাউল আর ১৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

কলমাকান্দার পাঁচকাটরা আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণের সময় সাংবাদিকদের কাছে  নেত্রকোণা -১ আসনের সংসদ সদস্য  মানু মজুমদার বলেন, কলমাকান্দা, দুর্গাপুরে বন্যা পরিস্থিতির খুবই খারাপ।

এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন নাগাদ যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা খুবই স্বল্প। এতো অল্প ত্রাণ দিয়ে শিবিরে আশ্রয় নেওয়া  ও বন্যায় কবলিত কলমাকান্দাতেই প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।