পারিবারিক অস্বচ্ছলতার জন্য যে সন্তানটি শহরের কলেজে পড়ার পাশাপাশি টিউশনিও করতে যেত, তার এই ধরনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না সোহাগী জাহান তনুর বাবা।
Published : 24 Mar 2016, 11:55 PM
তনু হত্যার বিচার দাবিতে উত্তাল কুমিল্লা
তনু হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ সর্বত্র, ‘তদন্তের স্বার্থে’ চুপ পুলিশ
“মেয়েটা একা একা কলেজে যেত। আমি ভয় পেতাম। সেই আমাকে সাহস দিত। আজ আমার সেই মেয়েকে…” কথা শেষ করার আগেই ধরে আসে ইয়ার হোসেনের কণ্ঠ।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এই ছাত্রীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি এখন দেশজুড়ে আলোচিত। দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীদের সরব হওয়ার সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের নামই হয়ে উঠেছে তনু।
কুমিল্লা শহরের বাইরে সেনানিবাস এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ১৯ বছর বয়সী তনু। কলেজ থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। সন্ধ্যায় টিউশনি করিয়ে ঘরে ফিরতেন তিনি।
টিউশনি করিয়ে ঘরে ফেরার পথে গত রোববার রাতে ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের কাছে তনুকে হত্যা করা হয়। পুলিশের ধারণা, খুনের আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল এই তরুণীকে।
ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইয়ার হোসেন পরিবার নিয়ে অলিপুর এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তার বাড়ি মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে। তনুকে কবর দেওয়া হয়েছে সেখানেই।
বৃহস্পতিবার মির্জাপুরে গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম এখনও থামেনি। তনুর পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে এসে জল ঝরলে গ্রামবাসীর চোখেও।
হাঁটতে হাঁটতে কাঁপতে কাঁপতে ইয়ার হোসেন বলছিলেন, “আমার জেঠি আদর করে তার নাম রেখেছিল সোহাগী। সবাই তাকে আদর করত।
“আমি আমার মাকে (তনু) বলতাম, মা, তোরে আমি বুকের মধ্যে আটকে রাখব। মেয়েটাকে বুকে টেনে নিতাম। সে বলত, ‘বাবা, আমি তো বড় হয়ে যাচ্ছি। তুমি কি পারবা আমাকে সব সময় বুকে রাখতে’?”
ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাসে বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন তনু। থিয়েটার করার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেই যুক্ত ছিলেন তিনি।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তনুর মা বলেন, “সেই ছোটবেলা থেকে অনার্স পর্যন্ত পড়তে গিয়ে কত পুরস্কার যে পেয়েছে তনু! ভালো গান গায়। তাই সব অনুষ্ঠানে তাকে ডাকত। কত স্টুডেন্ট ছিল তার!”
তনুর ভাই রুবেল এগিয়ে এসে মাকে থামাতে গিয়ে নিজেই আবেগে ভেসে যান। জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, “কয়দিন আগে আমি, আপু, আম্মু একসাথে ছবি তুলেছি। আপুর বার্থ ডে ছিল। আমরা কত মজা করতাম!”
এই সময় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “ইয়ার হোসেন শহরে চাকরি করে। মেয়েটা সবার ছোট। গ্রামে আসত বছরে একবার।
“আমরা বলতাম, এই মেয়ে একদিন অনেক বড় অফিসার হবে,” এরপরই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আল্লাহ, তুমি এর বিচার কর।”
জেলা শহরের বাইরে থেকে প্রতিদিন ভিক্টোরিয়া কলেজে যেতেন তনু। থিয়েটারের পর ছাত্র পড়িয়ে ঘরে ফিরতেন তিনি।
তনুর সতীর্থ মাইনুল হক স্বপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তার বন্ধু টিউশনি করতেন।
“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি,” ক’দিন আগেই নিজের ফেইসবুক পাতায় একথা লিখেছিলেন তনু।
হত্যাকাণ্ডের দিন ছাত্রের বাসা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বেরিয়েছিলেন তনু।তার দুই ঘণ্টা পর সেনানিবাস এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়।
সুরক্ষিত এলাকায় এভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহ-সভাপতি ওমর ফারুক বৃহস্পতিবার এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বলেন, “সেনানিবাসের ভেতরে এ হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মানতে পারছি না। ক্যান্টনমেন্টে মানুষ খুন হয় কীভাবে?”
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে পুলিশ তিন দিনেও শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে না পারায় বৃহস্পতিবার ক্ষোভ উগড়ে দেয় কুমিল্লাবাসী। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নেমে আসে নগরবাসীও।
ফেইসবুকে আহ্বান এসেছে সবাইকে নামার- “তনুকে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু আমরা সবাই তনু হয়ে জ্বলে তো উঠতে পারি!”