“মেলা নিয়ে স্থানীয় দুটি পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। দুইপক্ষের মামলা আছে। অনেকে আহত আছে।”
Published : 24 Mar 2025, 01:33 PM
ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে সাড়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ’ গ্রামীণ মেলা এ বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় মেলার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকার ১২ চৈত্র ধর্মীয় সাধক শাগির শাহের (রহ.) ওফাত (মৃত্যু) দিবসে বোয়ালমারী উপজেলার রূপপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামে মেলাটি শুরু হয়ে চলে প্রায় মাসব্যাপী। মেলাটি আগামী ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল।
স্থানীয় বিএনপির দুটি পক্ষ থেকে মেলা আয়োজনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করায় কোনও পক্ষকেই অনুমোদন দেয়নি প্রশাসন। তবে মেলা না হলেও ওরশের জন্য অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তানভীর হাসান চৌধুরী।
ইউএনও বলেন, “মেলা মিলানোর জন্য দুই গ্রুপে দুইটি কমিটির অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তাদেরকে বলা হয়েছে, দুই গ্রুপ যদি এক হতে পারেন তাহলে মেলা মিলান। কারণ ওই এলাকায় মেলাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ঘটনায় দুই গ্রুপেরই মামলা হয়।
“স্থানীয় দুটি পক্ষের হানাহানির কারণে মেলা নিয়ে নেগেটিভ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় পক্ষগুলোই চায় না মেলা হোক। আমরা কি করতে পারি? তবে সেখানে ওরশ শরীফ করতে কোনো বাধা নেই।”
এলাকাবাসী বলছেন, চলতি বছর ৩৫১ বারের মতো এ মেলার আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কারণেই মেলাটি বন্ধ হয়নি। এমনকি করোনা মহামারির সময়েও স্বল্প পরিসরে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।
মেলার প্রধান আকর্ষণ বাতাসা, কদমা, বালিশ রসগোল্লা, বাঁশের তৈরি জালি, ডালা, তালপাতার হাত পাখা, বেতের তৈরি ধামাসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র। এখানে কসমেটিক, খেলনা ও বিভিন্ন আসবাবপত্রের কয়েক হাজার দোকান বসে। থাকে নাগরদোলা, যাদু প্রদর্শনী, মোটরসাইকেল খেলা, পুতুল নাচ।
দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা বিভিন্ন মানত নিয়ে আসেন এখানে। প্রতিবছর মেলা দেখার জন্য মেলার আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
তবে এ বছরের চিত্রটা ভিন্ন দেখা গেছে। মেলার জন্য দুর-দুরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা দোকান পাট নিয়ে এলেও, অনেকেই স্থানীয়দের কাছ থেকে মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে ফিরে গেছেন।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, কাটাগড়ের এ মেলা আয়োজনের অনুমতি চেয়ে রূপাপাত ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আক্কাস মন্টু ও উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. আনিচুর রহমান টিটোসহ একটি পক্ষ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ৫ মার্চ আবেদন করেন।
তারা বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফরিদপুর-১ আসনের (বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা) বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শামচুউদ্দিন মিয়া ওরফে ঝুনুর সমর্থক।
অপরদিকে ১৬ মার্চ সাতদিনের অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন কাটাগড় দেওয়ান শাগির শা’র মাজারের খাদেম ইরাদত ফকির। তাকে দিয়ে আবেদন করান বোয়ালমারী বিএনপির অপর অংশ রূপাপাত ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া, ইউনিয়ন কৃষকদলের সভাপতি শাহীন মোল্লা, ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আকরাম শেখ, আজাদ মোল্যা, হাফিজুর মোল্যা ও আহাদ মোল্যাসহ অপর একটি পক্ষ।
এ পক্ষটি কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি ও আগামী সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী খন্দকার নাসিরুল ইসলামের সমর্থক।
দুপক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাটাগড় মেলার আয়োজন নিয়ে গত ১৫ মার্চ বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির বিবাদমান দুই নেতার অনুসারীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষের বিষয় নিয়ে স্থানীয় থানায় দুপক্ষের পাল্টপাল্টি মামলা হয়। এ নিয়ে দুটি পক্ষ মানববন্ধনও করে। যার কারণে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রশাসন মেলার অনুমতি দেননি।
রূপাপাত ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাটাগড় গ্রামের বাসিন্দা আক্কাস আলী মন্টু বলেন, “আমরা স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মী হিসেবে শামচুউদ্দিন মিয়া ঝুনু মিয়ার পক্ষে পড়েছি। আমাদের সঙ্গে ইউনিয়ন বিএনপির ‘অরজিনাল’ লোকজন আছে। আর খন্দকার নাসিরুল ইসলামের সঙ্গে রূপাপাত ইউনিয়নের কোনো বিএনপির লোক নাই। এ বছর কাটাগড় মেলা হচ্ছে না। শুধু ওরশের জন্য প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে।”
কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহ (রহ.) এর মাজারের ৯ম তম খাদেম সিদ্দিক ফকির বলেন, দেওয়ান শাগির শাহের ওফাত (মৃত্যু) দিবস উপলক্ষে ওরশকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করা হয়। সাড়ে তিনশ বছর ধরে কাটাগড় গ্রামে মেলা চলছে। আমি এখানে ২০ বছর ধরে খেদমত করছি। এর আগে আমার দাদা, তার বাবা খেদমত করেছে।
“মেলাটি কোনদিন বন্ধের কথা শুনি নাই। এ বছর কি কারণে বন্ধ হলো জানি না। আমরা চাই এখানে আবার মেলাটি শুরু হোক।”
মেলা কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও রূপাপাত ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. আজিজার রহমান বলেন, “কাটাগড় দেওয়ান শাগির শাহর ওরস উপলক্ষে প্রায় ৫২ বছর ধরে আমরা সকল দলের লোকজন মিলেমিশে মেলাটি করে আসছি। আমরা আওয়ামী লীগের লোক হওয়ার কারণে এ বছর আমাদের মেলা কমিটিতে রাখে নাই। এ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তিও নাই।
“বিএনপির দুইপক্ষের রেশারেশির কারণে এ বছর মেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তারা মেলা মিলানোর জন্য তিনবার কমিটি করেছে। গ্রামে একটি মারামারি ঘটনায় আমাদের লোকজন আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে।”
বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামচুউদ্দিন মিয়া ওরফে ঝুনু বলেন, “এ মেলা আয়োজনের জন্য ওই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করে মেলা আয়োজনের জন্য অনুমতি চান। এ সময় ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ একটি অংশ, যারা খন্দকার নাসিরুলের অনুসারী হিসেবে পাল্টা আবেদন জমা দেয়। পাশাপাশি নাসিরুলের সমর্থকরা হামলা চালিয়ে বিএনপির কর্মী সমর্থকদের উপর নিযাতন করেছে।”
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি সাবেক এমপি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপির কোনো দ্বন্দ্ব বা কোন্দলের কারণে মেলা বন্ধ হয়নি। মূল সমস্যা হচ্ছে, মেলা উপলক্ষে যে টাকা পয়সা ওঠে তার ভাগাভাগি নিয়ে। এতো দিন আওয়ামী লীগরা টাকা খেত, এখন অন্যরা খেতে চাচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপির লোক যে নেই তা বলা যাবে না।”
কাটাগড় মেলা এলাকায় তার কোন পক্ষ নেই দাবি করে খন্দকার নাসির বলেন, “নিজের স্বর্থের জন্য সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকে ‘অমুকের লোক’, ‘তমুকের লোক’ পরিচয় দিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে।”
বোয়ালমারী থানার ওসি মো. মাহামুদুল হাসান বলেন, “মেলা নিয়ে স্থানীয় দুটি পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। দুইপক্ষের মামলা আছে। অনেকে আহত আছে। মেলার আগেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে মেলার সময় বা পরে আরো খারাপ অবস্থা হতে পারে। এই আশঙ্কায় মেলার অনুমোদন না দেওয়ার জন্য ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”