Published : 03 Jan 2024, 09:47 PM
আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে এলাকায় আগে থেকেই নামডাক রয়েছে একজনের; আরেকজন জনদুর্ভোগকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামনে এনে ফেইসবুকের পরিচিত মুখ। ভোটের মাঠে এ দুজন এবার মুখোমুখি; সমর্থন নিজের দিকে টানার প্রচারে এখন ব্যস্ত তারা।
তবে তাদের জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশ নির্ভর করছে চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ আসনের ৮০ হাজারের বেশি শ্রমিকের ওপর।
আসনটি হল মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪; যেখানে প্রধান এ দুই প্রার্থীর পাশাপাশি চা শ্রমিকরা রয়েছেন ভোটের আলোচনায়। কেননা চা শ্রমিকদের জোয়ারই জয়-পরাজয়ে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
নামডাক থাকা এই প্রার্থী হলেন নৌকা প্রতীকের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এবং ফেইসবুকের অতি পরিচিত এই মুখ হলেন নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র হওয়া ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
এলাকায় সজ্জন হিসেবে পরিচিত দুইবারের সংসদ সদস্য মাহবুব আলী। এবার তিনি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন করছেন।
অপরদিকে ব্যারিস্টার সুমন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মনোনয়ন না পেয়ে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
তবে গত তিন দশকের ছয়টি নির্বাচনের তথ্যের হিসাব নৌকার জয়গানের কথাই বলছে। এবার এতে কতটা ধাক্কা দিতে পারবেন সোশাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ সুমন তা দেখার বিষয়।
আগের ছয় নির্বাচনে আসনটি মাত্র একবারই আওয়ামী লীগের বাইরে গেছে। মাধবপুর উপজেলায় অবস্থান দুর্বল হলেও চুনারুঘাট উপজেলাকে আওয়ামী লীগের ‘ঘাঁটি বা দুর্গ’ বলা যায়। মাহবুব আলীর বাড়ি মাধবপুরের বানেশ্বর গ্রামে আর ব্যারিস্টার সুমনের বাড়ি চুনারুঘাটের বড়াইল গ্রামে।
এ আসনে প্রার্থী আটজন হলেও এ দুজনের প্রচারে জমে উঠেছে নির্বাচনি এলাকা। পাশাপাশি দুই প্রার্থীরই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা থাকায় উভয় উপজেলার নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে তরুণ ভোটারদের মধ্যে ব্যারিস্টার সুমনকে নিয়ে বাড়তি আগ্রহের দেখা মিলছে অনেকখানেই।
অন্য ছয় প্রার্থী হলেন- জাতীয় পার্টির আহাদ উদ্দিন চৌধুরী (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আল আমিন (ডাব), ইসলামী ঐক্যজোট বাংলাদেশের আবু ছালেহ (মিনার), বিএনএমের মো. মুখলেছুর রহমান (নোঙ্গর), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মো. আব্দুল মমিন (চেয়ার), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ঐকজোটের মো. রাশেদুল ইসলাম খোকন (ছড়ি)।
প্রতীক পাওয়ার পর থেকে এসব প্রার্থীও নির্বাচনি এলাকায় প্রচার চালাচ্ছেন। ভোটের প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে এখানে বড় ধরনের কোনো নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে এরই মধ্যে দুবার ঈগল প্রতীকের প্রার্থী সুমনকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি।
শিল্প-কারখানা ও চা বাগান অধ্যুষিত এ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১২ হাজার ৩০৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৪। নারী ২ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৩ জন। হিজড়া ভোট রয়েছে একটি।
এ আসনের ২৪টি চা বাগানে ভোট রয়েছে ৮০ হাজারের বেশি। আগের ভোটের তথ্য বলছে, এর বড় অংশই গেছে নৌকার বাক্সে।
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন এনামুল হক।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য হন মাহবুব আলী।
বিএনপি এ আসন থেকে না জিততে না পারলেও তাদের ভোট ব্যাংকটি বড়। সবসময় ১০ থেকে ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে।
যা বলছেন ভোটাররা
চা শ্রমিকরা এ আসনে ভোটের মূল চালিকাশক্তি হওয়ায় প্রধান দুই প্রার্থীই নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহবুব আলী প্রতিদিনই তাদের কাছে ছুটছেন।
তবে দুই উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো চা বাগানের নেতারাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। চা-শ্রমিকদের মধ্যেও ভোট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
তাদের মতো অন্য ভোটাররাও সরাসরি এ দুইজনকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে তাদের পছন্দের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা গেছে।
চানপুর চা বাগানের শ্রমিক খাইরুন আক্তার বলেন, “আমরা প্রতি বছরই নৌকায় ভোট দেই। এবারও নৌকায় দেব। আমরা চাই দেশের সরকার শেখ হাসিনা থাকুক।”
একই বাগানের শ্রমিক নেতা সাধন সাঁওতাল বলেন, “আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুব আলী খুবই নম্র ও ভদ্র মানুষ। তিনি একজন যোগ্য প্রার্থী। আমরা উন্নয়নের স্বার্থে তাকে এবারও ভোট দেব।”
নালুয়া চা বাগানের শ্রমিক অজিত তাঁতী বলেন, “আমরা প্রতিবারই নৌকায় ভোট দেই। তবে এমপি মাহবুব আলী বিজয়ী হয়ে আমাদের পাশে থাকেন না। অন্যদিকে ব্যরিস্টার সুমন আমাদের খোঁজ-খবর রাখছেন। এবার আমরা ব্যারিস্টার সুমনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে চাই।”
একই বাগানের শ্রমিক আবেদ মিয়া বলেন, “ব্যরিস্টার সুমন নিজের টাকা খরচ করে আমাদের পাশে ছিলেন। এ বছর আমরা তার ঈগল মার্কায় ভোট দেব।”
উবাহাটার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষার্থী শিরিন আক্তার স্বপ্না বলেন, “আমরা চাই শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দেব। তবে এবার সবার কাছে প্রিয় প্রার্থী ব্যারিস্টার সুমন।”
স্থানীয় গোয়াছপুর গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান সোহাগের দাবি, প্রত্যাশানুযায়ী উন্নয়ন করতে পারেননি মাহবুব আলী। অন্যদিকে ব্যারিস্টার সুমন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করেছেন। কাঠের সেতু করে দিয়েছেন। যে কারণে তিনি এ আসনে সুমনকে জয়ী দেখতে চান।
২ নম্বর আহম্মদাবাদ এলাকার মুজিবুর রহমান পলাশ বলেন, অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা। সারা জীবন তিনি আদর্শের রাজনীতি করেছেন। ত্যাগী বলেই তিনি আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আবারও তাকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন বলে তার মত।
কলেজ শিক্ষার্থী খাদিজা হারুন বলেন, মাহবুব আলী জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে মাধবপুরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। এবার নির্বাচনে এমপি হিসেবে তার বিকল্প নেই।
চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশী ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহাগ বলেন, “প্রত্যাশানুযায়ী উন্নয়ন করতে পারেননি মাহবুব আলী। অন্যদিকে ব্যারিস্টার সুমন সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে এবার ওই আসনে আমরা ব্যারিস্টার সুমনকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই।”
চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন পলাশ বলেন, “একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ মাহবুব আলী। যে কারণে এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আবারও মাহবুব আলীকে প্রয়োজন।”
চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবেদ হাসনাত চৌধুরী সন্জু বলেন, “চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। দিন দিন নৌকার ভোট বাড়ছে। জনগণ এবারও নৌকায় ভোট দেবে। আশা করছি, এবারও আমাদের নৌকার প্রার্থী মাহবুব আলী এমপির বিজয় হবে।”
জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আব্দুল কাদির লস্কর বলেন, “নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে দলীয় নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। নৌকার প্রার্থী হিসেবে মাহবুব আলী একজন যোগ্য প্রার্থী। জনগণ তাকে এবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে।”
মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহ মো. মুসলিম বলেন, “মাহবুব আলী এই আসন থেকে পরপর দুইবার নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি তেমন উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারেননি। ব্যরিস্টার সুমন এলাকায় অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তি এবং সব সময় মানুষের পাশে রয়েছেন। আশা করছি বিপুল ভোটের ব্যবধানে তার জয় হবে।”
দুই প্রার্থীর কথা
ভোটে কেমন সাড়া পাচ্ছেন জানতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সুমন জয়ের মালা নিয়ে ঘরে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করছেন, জনগণ এটাকে কীভাবে নিচ্ছে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভোটাররা এখন সচেতন। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, আমি নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করছি না। মাঝি বদলের নির্বাচন করছি।
“চা শ্রমিক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার ভোটার আমাকে এবার নির্বাচিত করবে।”
আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব বলেন, “এই এলাকার মানুষ সবসময় নৌকায় ভোট দিয়ে আসছে। আমি সারাজীবন তাদের সঙ্গে কাটিয়েছি। নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। তাই আমার জয় নিশ্চিত।”
বলেন, “এখানে চা শ্রমিকরা সব সময় নৌকায় ভোট দেয়। এবারও নৌকায় ভোট দেবে। আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন। একজন প্রার্থী ওই সংগঠনের কাছে কিছুই না।”