মাঝি-মাল্লারা যখন ঘাটে নৌকা বেঁধে খেতে বাড়ি এসেছিল সেই সুযোগে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকার পাটাতনে ঢুকে পড়েন ফরজ আলী।
Published : 02 Dec 2022, 02:00 PM
মুক্তিযোদ্ধা ফরজ আলী অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় নৌকার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন ট্রেনিংয়ে। পরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দেখে অবাক হলেও একসঙ্গে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে সরাসরি ঢুকে পড়েন রণাঙ্গনে। অংশ নিয়েছেন সম্মুখযুদ্ধে।
ফরজ আলী নিজে এবং তার সহযোদ্ধারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেই যুদ্ধদিনের কাহিনি শুনিয়েছেন।
ফরজ আলীর বাড়ি যমুনার দুর্গম চর সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার ভাটিমেওয়া খোলা হলেও শৈশবে বেড়ে উঠেছেন বগুড়ার ধুনটের চিথুলিয়ায়।
প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বগুড়ার গোসাইবাড়ী এ এ উচ্চ বিদ্যালয়ে। জায়গীর থাকেন চিথুলিয়া গ্রামে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি নিজ গ্রাম ভাটিমেওয়া খোলায় চলে যান। সেখান থেকে বাবা-মাকে না জানিয়ে একদিন ভারতে যান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য।
গোসাইবাড়ী এ এ উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এবং পাশের উজানমেখলা গ্রামের সত্তর বছর বয়সী বৃন্দাবন সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফরজ আলী যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে তখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়েন। তার চেয়ে ছোট হলেও খেলাধুলা এবং চলাফেরা করতেন একসঙ্গে। স্কুলে এবং গ্রামের বাড়িতে তারা অবসরে চলতেনও একসাথে।
“মুক্তিযুদ্ধে সে যখন যায় তখন আমি কলেজে পড়ি। পাশাপাশি দুটি গ্রাম হলেও সীমানা ছিল দুই বাড়ির কাছাকাছি। একদিন শুনলাম ফরজ আলীকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই উদ্বিগ্ন। তার বাবা-মার কান্না থামছিল না। পাশেই যমুনা নদী। কেউ কেউ ভাবছিল হয়ত বা যমুনায় ভেসে গেছে। তখন যমুনা ছিল উত্তাল, ভয়ংকর।”
বৃন্দাবন সরকার বলেন, “ভারত থেকে যখন ট্রেনিং করে ফিরল তখন আমরা জানলাম ফরজ আলী মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়েছিল। তখন ফোন কিংবা মোবাইল ছিল না; তাই তার খোঁজ জানানো সম্ভব হয়নি।”
ফরজ আলী সৎ ও মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলে জানান সদানন্দ সরকার।
ফরজ আলীর সঙ্গে ভারতে ট্রেনিং নেওয়া এবং ফিরে এসে যুদ্ধে অংশ নেওয়া ৭১ বছর বয়সী এ এস এম তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কম বসয়ী ফরজ আলীকে দেখে আমরা হতবাক হয়েছিলাম।
“কীভাবে কার সাথে এল এবং অল্পবয়সে কেন এল জানতে চাইলে বলেছিল – ‘দেশ স্বাধীন না হলে পরাধীন দেশে বাস করে লাভ কী? তাই স্বাধীনতার যুদ্ধে সবার অগোচরে নৌকার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে এসেছি।’”
তরিকুল ইসলাম বলেন, “ভারতে ট্রেনিংয়ের সময় একই এলাকার হওয়ায় দার্জিলিং জেলার পানিঘাটা ক্যাম্পের লিমা কোম্পানিতে বীরবল গুর্খার অধীনে একই গ্রুপে ট্রেনিং করি। বয়স কম হওয়ায় তাকে (ফরজ আলী) ট্রেনিংয়ে নিতে চায়নি; কিন্তু তার অনুরোধ এবং আমরা তাকে ট্রেনিংয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করি।”
ট্রেনিংয়ে যা শেখানো হতো তা ফরজ আলী বড়দের চেয়েও ভালো মনে রাখতে পারতেন বলে তরিকুল ইসলাম জানান।
ফরজ আলীর বিষয়ে মজার একটি গল্প বলেন তরিকুল ইসলাম।
ট্রেনিংয়ের সময় প্রতি গ্রুপে ১০০ জন করে ফুটবল খেলা হতো। যে টিম হারবে তাদের অন্য টিমের খেলোয়াড়দের কাঁধে করে ক্যাম্পে আনতে হতো। ফরজ আলী ছিল ছোট এবং পাতলা তাই ফরজ আলীর টিম হারুক কিংবা জিতুক ফরজ আলীকে অন্য কেউ কাঁধে করে ক্যাম্পে আনতো। আর এটা নিয়ে নিজেদের মাঝে হাসি-ঠাট্টা হতো। ক্যাম্পে সবার ছোট হওয়ায় তাকে সকলেই আদর করত এবং প্রশিক্ষকও ভালোবাসতেন।
তরিকুল ইসলাম জানান, তাদের ১৫ জনের টিমের কমান্ডার ছিলেন সামছুল হক। দেশে ফিরে তারা দুর্গম চরাঞ্চলে প্রথমে অবস্থান নেন।
“সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থানা যখন ডিসেম্বরের ২ তারিখে দুপুর ৩টায় আক্রমণ করলাম তখন ফরজ আলীর ফাইটিং এবং মনোবল দেখে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”
তিনি বলেন, ওই যুদ্ধে আমাদের তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হলেও পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। তবে বড়দের অনুসরণ করত এবং কমান্ড অনুযায়ী দৃঢ়তার সাথে কাজ করত ফরজ আলী।
ফরজ আলী জানান, যুদ্ধ শেষে ফিরে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন গোসাইবাড়ী এ এ উচ্চ বিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। আইনের ডিগ্রিও নেন। পরে প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড স্টেটস, থেকে পিএইডি করেন।
চাকরি জীবনের প্রথমেই তিনি ব্যাংকে যোগ দেন। জনতা ব্যাংকের ডিএমডি হিসেবে চাকরি জীবন শেষ করেন। পরে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালকসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।
বর্তমানে তিনি বগুড়া শহরের ফুলতলায় স্থায়ীভাবে বসত গেড়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা ড. ফরজ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তার জীবনের নানা কথা বলেছেন।
“তারিখটা মনে নেই; তবে ১৯৭১ সালের জুলাই কিংবা অগাস্ট মাস হবে। নদীপথে ওই সময় মানকার চর হয়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে প্রায়ই নৌকা যাচ্ছিল। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম; কিন্তু কাউকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। একদিন শুনলাম আমাদের গ্রামের ঘাট থেকে নৌকা যাচ্ছে ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য। সাথে আমার মামাও যাবে।
“নৌকার মাঝি-মাল্লারা ঘাটে নৌকা বেঁধে যখন খেতে বাড়িতে এসেছিল সেই সুযোগে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকার পাটাতনে ঢুকে পড়ি। আনুমানিক দুপুর ১২টা কিংবা ১টা হবে; নৌকা ছেড়ে দিল। চুপচাপ বসেছিলাম পাটাতনের নিচে; নড়াচড়া বন্ধ করে। কাশি আসলেও মুখ চেপে ধরে শব্দ বের হতে দেইনি।”
তিনি বলেন, উত্তাল যমুনায় পাল তুলে উজান বাইছে মাঝি। পাকসেনারা যেন বুঝতে না পারে সে কারণে হারিকেন, কুপি সব নিভিয়ে দিয়েছিল নৌকার মাঝি।
“পাটাতনের নিচে বসে সবার কথা শুনছিলাম। ফিসফিস করে বলছিল বাহাদুরবাদ ঘাট পার হলেই বিপদমুক্ত। পাক আর্মি সার্চ লাইটে পর্যবেক্ষণ করে। সন্দেহ হলেই গুলি চালায়। কয়েকটি এমন ঘটনার কথাও বলছিল। আমি তাদের কথা শুনে চুপসে যাই। আবার ভাবছিলাম, না কিছুই হবে না; আর আল্লাহকে ডাকছিলাম, মনে মনে দোয়া পড়ছিলাম।”
মাঝিরা নৌকা এমন ভাবে ছেড়েছিল যে বাহাদুর বাদ এসে যেন ভোর হয়।
“একেতো বর্ষাকাল, উত্তাল যমুনা, বৃষ্টিতে এবং বাতাসে উজানে নৌকা যাচ্ছিল ধীর গতিতে। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকে আলোয় ভরে উঠছিল যমুনা। যেন পাক বাহিনীর সার্চ লাইটের মত। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে উঠছিল নৌকার যাত্রীরা। আর মেঘের গর্জন মনে হচ্ছিল যেন পাক বাহিনীর গুলির শব্দ। পাকবাহিনী এবং প্রকৃতির আতঙ্ক নিয়েই চলছিল আমাদের ভারত যাত্রা।
তখনও আমি নৌকার পাটাতনের নীচে নিঃশব্দে অনিশ্চিত যাত্রায় ভয় আর শঙ্কায় ভাবছিলাম
ভারতে ট্রেনিংয়ে যাওয়া হবে কি? না, পাকবাহিনীর গুলিতে সলীল সমাধি হবে? মৃত্যু হলে বাবা-মা কেউ জানবে না কোথায় কিভাবে হারিয়ে গেলাম। তারা শুধু কাঁদবে সন্তানের জন্য।
হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। আজানের ধ্বনি কানে বাজলো। ভাবলাম বাহাদুরবাদ ঘাট পার হচ্ছি, বিপদমুক্ত। একটু পরে পাটাতনের নীচ থেকে শুনছি- সবাই বলছে আর ভয় নেই। তখনই টানা ১৮ ঘণ্টা পর পাটাতনের নীচ থেকে বেরিয়ে আসি আমি। আমাকে দেখে সবাই হতবাক কিন্তু আমার মামা মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক রাগান্বিত হয়ে উঠলেন।
কিন্তু আমি চুপচাপ কথা না বলে বসে থাকলাম। মামার সাথে তো কথা বলা মানে বেয়াদবী। কিন্তু তখন আমাকে বাড়িতে ফেরানোর কোনো পথ ছিল না তাই সঙ্গে নিয়েই চললো এবং মামা নানা ধরনের কথা বলতে থাকলো।
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বলেন- বগুড়ার ধুনটের গোসাইবাড়ী হাট অনেক বড় হাট। গুজব ছড়িয়েছিল পাকিস্তানি আর্মি আসছে, এর মধ্যেই লুট হলো সেই হাট। যে যার মত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
“আমি তখন পাশের শহড়াবাড়ী থেকে আসছিলাম। একজন আটার বস্তা লুট করে আনছে। আটা দিয়ে তার পুরো মুখ ঢাকা। তারমত অনেকেই হাট লুট করে আনছে। তারপর গ্রামের বাড়িতে ফিরেই সিদ্ধান্ত নেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।”
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে ড. ফরজ আলী বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়েছে তাদের সম্মান দিয়ে তালিকাভুক্ত করুন। এমনও আছে একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাদের সাক্ষ্য প্রয়োজন কিন্তু তারা বেঁচে নেই সে কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন- যথাযথ যাচাই করে তাদের বিষয়টিও দেখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, “যারা মুক্তিযোদ্ধা নন, তারা ঘোষণা দিয়ে ভাতা, সুবিধা সারেন্ডার করুন। না হলে এক সময়ে প্রমাণিত হবে মুক্তিযোদ্ধা নন, তখন সন্তান, স্ত্রী-স্বজনরা লজ্জিত হবেন।”