“যারা কাজের জন্য নিয়ে যায় তারা লোক ভালো হলে থাকা খাবারের অসুবিধা হয় না। আবার অনেকে আছে, যারা আমাদের মানুষই মনে করে না।”
Published : 30 Jan 2024, 10:38 AM
সবে ভোরের আলো ফুটেছে; বেশিরভাগ মানুষ তখনও ঘুমিয়ে। কিন্তু কুমিল্লার কয়েকটি এলাকা লোকজনের কোলাহলে সরগরম হয়ে উঠেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে হাট বসেছে; তবে এ হাটে নেই কোনো পণ্য।
এখানে পণ্যের মত বিক্রি হয় শ্রম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ এ হাটে আসেন শ্রম বিক্রির জন্য। তাদের শ্রম বিক্রি হয় দিন, সপ্তাহ বা মাস চুক্তিতে।
প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় নগরীর কান্দিরপাড়, সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী বাজার, পদুয়ার বাজার, চৌয়ারা বাজার, বিজয়পুর বাজার, নগরীর শাসনগাছা, বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার, লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজার, লাকসামের বিজরা বাজার ও মুদাফ্ফরগঞ্জ বাজারসহ অন্তত ১৫টি স্থানে ‘মানুষের হাট’ বসে।
কান্দিরপাড় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, টাউনহল গেট, টাউন হল মার্কেট ও পূবালী চত্বরের সামনের সড়কে প্রায় তিনশ মিটার এলাকা জুড়ে বসেছে ‘মানুষের হাট’। শ্রমিকরা কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছেন। খদ্দের এলে শ্রমিকরা জড়ো হন। আবার অনেক শ্রমিক ‘কাজ নেবেন’ বলেও ডাকতে থাকেন।
কুমিল্লায় শ্রম বিক্রি করতে আসা বেশিরভাগের বাড়ি রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, নেত্রকোণা, ঠাকুরগাঁও, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলায়। তাদের অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী ও গৃহস্থালির কাজ করেন।
ধান রোপণ ও কাটার সময় কুমিল্লায় প্রতিদিন সাত হাজারের মত শ্রমিক শ্রম বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। অন্য সময়ে ৪ থেকে ৫ হাজার; যাদের বেশিরভাগই নির্মাণ কাজ করেন বলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা শ্রমিক আলামীন জানান।
বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ শ্রমিক রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “দৈনিক ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হন নির্মাণ ও কৃষি শ্রমিকরা। আর দৈনিক ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হন গৃহস্থালির শ্রমিকরা। মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতেও অনেকে কাজ করেন। কাজ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক বেতন নেন কিছু শ্রমিক।
“আমার পরিবারের সদস্য ছয়জন; এলাকায় যে কাজ আছে তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে এসেছি। যদিও প্রতিদিন কাজ পাই না; সপ্তাহে ২/১ দিন খালি হাতে ফিরতে হয়।”
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে হাটে এসেও সকাল ৯টার মধ্যে যারা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, তাদেরই ফিরতে হয় ‘শূন্য হাতে’। শ্রমিকদের কেউ কেউ আসেন দুই-এক মাসের জন্য। থাকার সুবিধা কিংবা ভালো কোনো কাজ পেলে থেকে যান বছরের পর বছর। আবার টানা কয়েকদিন কাজ না পেলে অনেকে এক হাট থেকে অন্য হাটে জায়গা বদল করেন।
যেসব শ্রমিক কাজ পান না তারা বিভিন্ন স্কুলের বারান্দা, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কিংবা রেলস্টেশন এলাকার কম দামি হোটেলে আশ্রয় নেন। আবার নিয়মিত কাজ পেলে অনেক শ্রমিক বাসাবাড়িতে অথবা মেসে থেকে যান। হাতেগোনা কয়েকজন পরিবার নিয়ে কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় থাকেন।
শ্রমিকরা হাটে আসার জন্য দলে দলে ছোটেন ছেঁড়া লুঙ্গি, শার্ট, টি-শার্ট ও পুরোনো প্যান্ট পরে; গলা ও কোমরে গামছা বাঁধা থাকে। পোশাক যেমনই হোক তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তান ও পরিবারের লোকজন নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই কাজ। আর এ কাজ পেতেই ঘুম চোখ নিয়ে চলে তাদের লড়াই।
ঠাকুরগাঁও থেকে আসা একটি শ্রমিক দলের প্রধান আবদুল মতিন জানান, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ শ্রম বিক্রি করে। তাদের দলে ৩৫ জন রয়েছে, একটি বস্তিতে একসঙ্গে থাকেন তারা।
গাইবান্ধার আবুল বাশারের সংসারের চাকা ঘুরে গৃহস্থালি আর নর্দমা পরিষ্কার করে। মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা রোজগার করেন বলে জানান এ শ্রমিক।
তিনি বলেন, “বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, নবম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ে আছে। থাকা-খাওয়া মিলিয়ে অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে যায় কুমিল্লা শহরে। বাকিটা বাড়িতে পাঠাই।”
দিনাজপুরের শ্রমিক মেহেদী হাসান বলেন, “আমরা কাজ না পেলে অনেক কষ্টে দিন পার করি। অনেক সময় না খেয়েও থাকি। আর পরিবারের জন্য তো কিছু পাঠাতেই পারি না।”
সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজারে কথা হয় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মমিন মিয়ার সঙ্গে। আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ার কারণে কাজের আশায় কুমিল্লায় এসেছেন বলে ২২ বছর বয়সী এই তরুণ জানান। কোনো কোনো দিন কাজ পান, আবার কোনো দিন তাকেও খালি হাতে ফিরতে হয়।
ওই উপজেলার বিজয়পুর বাজারে দুই বছর ধরে শ্রম বিক্রি করেন ময়মনসিংহের সুজন মিয়া। বলেন, “যারা কাজের জন্য নিয়ে যান, তারা লোক ভালো হলে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হয় না। আবার অনেকে আছে, যারা আমাদের মানুষই মনে করেন না।”
বাসার ছাদে ফুল বাগান বানাবেন তাই কান্দিরপাড়ে শ্রমিকের খোঁজে এসেছেন কুমিল্লা নগরীর ছোটরা এলাকার আশিকুর রহমান।
তিনি বলেন, “শ্রমিক দরকার তাই ভোরেই চলে এসেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে এখানে লোক পাওয়া যায়; তারা কাজেও বেশ আন্তরিক। তাই বেশিরভাগ মানুষই এখানে শ্রমিক নিতে আসেন।”