স্বজনরা জানান, এসএসসি পাস করার পর বাড়ি ছেড়েছেন লিটন। তারপর থেকে খুব বেশি আসা হত না তার।
Published : 13 Jul 2024, 09:38 AM
পিএসসির প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের একজন লিটন সরকার। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে পাস করে বের হওয়া লিটনের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্নপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামে।
সেই গ্রামে গিয়ে লিটনের বাবা-মাসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধারদেনা করে তাকে পড়াশোনা করায় পরিবার। দরিদ্র পরিবারের সন্তান লিটনকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল, লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরি করে পরিবারের অভাব গোছাবেন লিটন। কিন্তু তিনি পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছেন তা পরিবারের কেউ জানেন না।
সন্তান মামলার আসামি হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে সবার মাঝে হতাশার পাশাপাশি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঙ্কও বিরাজ করছে।
লিটনের মা লীলা সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই ছেলে ও এক মেয়ে তার। ছোট ছেলে প্রতিবন্ধী, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “বড় ছেলেকে (লিটন সরকার) দিনমজুরি দিয়া পড়ালেহা করাইছি। এহন কী করমু, হে মুই কইতে পারি না।”
লিটনের বাবা নির্মল সরকার বলেন, “মাঝে মধ্যে কাম কইরা যা পাইছি, ছেলেরে দিছি। পাঁচ লাখ টাহার জমি বিক্রি কইরা ইনিভার্সিটিতে ভর্তি করাইছি; হ্যাতে হয় নাই। ভাই, তিনডা গরু বেইচ্যা, লোনের টাহা দিয়া পড়াইছি। আর্থিকভাবে বেতাল হইয়া পড়ছি।
“বাবা বইলা না, গ্রামের সকলের কাছে জানেন, আমার ছেলে খারাপ না।”
একটি চক্র প্রায় এক যুগ ধরে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বলে ছয়জনের ছবিসহ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রোববার প্রচারিত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে।
এরপরেই সিআইডি তদন্ত করে ওই ছয়জন ছাড়াও অন্য যাদের নাম পেয়েছে অভিযানে নেমে লিটন সরকারসহ মোট ১৭ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে পিএসসির দুজন উপপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালকও আছেন।
বুধবার আসামিদের মধ্যে লিটন সরকারসহ ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পিএসসি এরই মধ্যে তাদের পাঁচজনের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে চিঠি দিয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় লিটন সরকারকে ১৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির শুক্রাবাদ কাঁচাবাজার এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন।
শুক্রবার লিটনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বহু পুরনো একটি টিনের ঘরই বাড়িটির মূল স্থাপনা। ঘরটির বারান্দা বলতে কিছু নেই। লিটনের বাবা-কাকাদের পরিবার সেখানেই থাকেন। বাড়িতে লিটনের এক ভাই ছাড়াও কাকাত ভাই-বোনেরা রয়েছেন।
মূল ঘরটির পাশে একটি ছোট রান্নাঘরের মতো রয়েছে। তার পাশে নতুন একটি ছোট কাঠের ঘর নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। সেটিও মাটির ভিটেতেই। গ্রামের বাড়ি হলেও জায়গাটি খুব বড় নয়। গোয়াল ঘরটিও কোনো রকমে দাঁড় করানো। সেখানে গরু আছে।
পরিবারের সদস্যরা জানালেন, লিটনের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়ার পর থেকেই বাড়ির সবাই নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অভাবের মধ্যে ঢাকায় গিয়ে কীভাবে খোঁজ-খবর নেবেন, মামলা কীভাবে চালাবেন- এই দুশ্চিন্তাও রয়েছে তাদের। এমনিতেই পরিবারের অনেক ঋণ।
লিটনের কাকী মধু সরকার বলেন, “টাহা-পয়সা সংসারে যা ছিল তা সবই ওর পিছনে ঢালছে। আমরা এহন খাডিপিডি (কাজকর্ম করে) খাই। পাওনাদাররা বাড়ি আইয়া গালাগালি করে। হ্যাগো বুঝ দেই, লিটু যদি এট্টু দাঁড়াইতে পারে, তোগো টাহা তোরা পাবি। তোগো টাহা দেবে। তোগো টাহা মাইররা খাইবে না। এই রহম কইয়া কইয়া রাহি।”
তিনি বলেন, “তাদের ২৪ কড়া (এক কড়ায় দুই শতাংশ) জমি পাঁচ লাখ টাহায় বিক্রি করে লিটনরে দেওয়া হইছে। স্বপ্ন ছিল, ও চাকরি করবে; ভাই-বইনরে দেখবে। কিন্তু কোনোভাবে পরানডারে বুঝ দিতে পারি না।
“ও কী করল! শয়তান-বদমাইশ পোলা না। কিসের মধ্যে পড়ছে, কোন শয়তানির মধ্যে পড়ছে। ও আস্তে কথা কইতো, কারো সাথে বেশি কথা কইতো না। ওরে কিসে ফালাইছে কইতে পারি না। ওরে যেকোনো একটা লালসা দেহাইছে; নয় একটা হুমকি-ধুমকি দিছে।”
লিটন মাস তিনেক আগে তার এক সহপাঠীকে বিয়ে করেছেন জানিয়ে মধু সরকার বলেন, “বউ নিয়া হে এহনও বাড়ি আহে নাই। যে ঘর আছে ওই ঘরে তো বউ নিয়া থাহা যাইবে না। তাই একটা নতুন ঘরের কাজও শুরু করে। তয় টাহার অভাবে কাজ অল্প একটু করা হইছে।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার বারপাইক্কা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন লিটন। ২০১৫ সালে বরিশাল নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৪.৯১ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরে ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি হন।
স্বজনরা জানান, এসএসসি পাস করার পর বাড়ি ছেড়েছেন লিটন। তারপর থেকে খুব বেশি বাড়ি আসা হত না তার; উৎসব-পার্বনেও না। নিজের বিয়ে উপলক্ষে মাস পাঁচেক আগে একবার এসেছিলেন।
লিটনের চাচা সুনীল সরকার বলেন, “আমি ও লিটনের বাবা জায়গা ও তিনটি গরু বিক্রি কইরে পড়তে টাহা দিছি। অগ্রিম টাহা লয়া লিটনের পড়ার খরচ দিছে বাপে। পড়ে কাজ করে সেই টাহা পরিশোধ করে। বাড়ির জমি বন্ধক, কৃষি ঋণ হিসাবে ৭৫ ও ৪০ হাজার টাহা তোলা হয়।”
লিটনের ঠাকুরমার দাবি, তার নাতির পড়াশোনার জন্য একটি পিতলের হাঁড়ি, পাঁচটি কলসি, একটি ঘট, পিতলের সিন্ধুক ও থালা বিক্রি করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
শিল্পী সরকার নামে লিটনের আরেক চাচি বলেন, লিটনের বাবা ও দুই চাচা কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। জমি, গরু বিক্রি ছাড়াও লাখ লাখ টাকা ঋণ করে লিটনকে পড়াশোনার খরচ দিয়েছেন।
তিন মাস আগে লিটন সরকার তার এক সহপাঠীকে বিয়ে করেছেন জানিয়ে শিল্পী সরকার বলেন, “স্ত্রীকে নিয়ে সে ঢাহায় থাকত।”
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের বিষয়ে নমিতা সরকার নামে লিটনের আরেক চাচি বলেন, “কোনভাবে কী অইছে সেইডা আমরা বাড়ি বইয়া কেমনে জানমু? ও তো ঢাহায় পড়ে। আমরা তো কোনোদিন ঢাকা-ঢোকা যাইও নাই; জানিও না এইসব খবরাদি।
“এডা কইতে পারবে ওর বন্ধু-বান্ধব। ও যাদের সাথে চলাফেরা করে তারা জানতে পারে।”
নমিতা সরকারের দাবি, লিটন যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছে, সে ড্যাফোডিলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু ওই মেয়েও লিটনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জানত না।
লিটনের স্ত্রী সুস্মিতার বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার রাখালতলা বলে জানিয়েছেন নমিতা।
খোকন সরকার নামে এক প্রতিবেশী বলেন, “লিটন এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। স্কুলে যখন পড়তো তখন দেখতাম। এখন বাড়ি একটু কম আসে। ওদের কোনো সম্পদ নেই। তবে ঢাকার ব্যাপারটা আমরা জানি না।”
আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্নপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিধান রায় বলেন, লিটনের অভিভাবকরা এ বিষয়ে তার কাছে কিছু বলেননি।
“কিন্তু রাস্তা-ঘাটে আলোচনা-সমালোচনায় শুনেছি, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন কম্পিউটারের মাধ্যমে ফাঁস করেছে সে। শুনছি, সে নাকি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।”
বিধান রায় আরও বলেন, “লিটন ছেলে হিসেবে ভালো ছিল। এখন কী করে সেটা বলতে পারব না।”