প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা।
Published : 27 Mar 2025, 10:43 AM
সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জ থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে আহরণ করা হচ্ছে গোলপাতাসহ নানা বনজ সম্পদ। বনজীবীদের অভিযোগ, পদে পদে দেওয়া ‘ঘুষের খরচ’ পোষাতেই আইন ভাঙতে হচ্ছে তাদের।
এবার খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হবে ৩১ মার্চ। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা।
এর পরপরই অভিযোগ ওঠে- বাওয়ালিরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন। এ ছাড়া পাতার আড়ালে বন থেকে বিভিন্ন গাছের খণ্ড আনা হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
পাশাপাশি সুন্দরবনের গোলঝাড়ে ‘ঠ্যাকপাতা’ না রেখে ঝাড়ের সব পাতা কাটা হয়েছে। যদিও নিয়ম রয়েছে, পাতা কাটার সময় গোলঝাড় রক্ষায় মাঝপাতার (মাঝের কচি পাতা) পাশে একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা (ঠ্যাকপাতা) রেখে আহরণ করার।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশন সমন্বয়ক ওবায়দুল কবির সম্রাট বলেন, “গোলপাতা আহরণ মৌসুমে নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। ৫০০ মণ ধারণক্ষমতার একেকটি নৌকায় বর্ধিত অংশ জোড়া দিয়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ গোলপাতা বোঝাই করে আনা হচ্ছে।
“এ ছাড়া গোলপাতার আড়ালে বন থেকে আনা হচ্ছে বিভিন্ন গাছের খণ্ড। পাশাপাশি ঝাড় ধ্বংস করে পাতা কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গোলবন।”
তিনি বলেন, “সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সেটি সুন্দরবনের ক্ষতি করে নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণ। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।”
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের একটি প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদ গোলপাতা। গোলপাতা আহরণ মৌসুমে একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বনবিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতার জন্য বনবিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।
উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নামে গোল হলেও গোলপাতা আসলে গোলাকার নয়, লম্বাকৃতির। এর পাতা সবুজ বর্ণের, নারিকেল পাতার মতো।
ঘর নির্মাণের উপকরণ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে এ পাতা ব্যবহার করে আসছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। গোলপাতার ছাউনির ঘরে গরমের সময় ঠান্ডা এবং শীতের সময় গরমভাব অনুভূত হয়। এ পাতা দিয়ে ভালোভাবে ঘরের ছাউনি দিলে তিন-চার বছর অনায়াসে পার হয়ে যায়।
তবে তুলনামূলকভাবে এখন গোলপাতার চেয়ে টিনের দাম কম হওয়ায় দিন দিন এর ব্যবহার কমছে। আর চাহিদা কমে যাওয়ায়, আগের তুলনায় গোলপাতা সংগ্রহকারী বনজীবীর সংখ্যাও কমেছে।
খুলনার নয়টি উপজেলার মধ্যে সর্বদক্ষিণের সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রার বেশিরভাগ মানুষই অবস্থানগত কারণে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। জেলার সুন্দরবন প্রভাবিত অন্য উপজেলাটি হলো দাকোপ।
এ উপজেলা দুটির সুন্দরবন-লাগোয়া গ্রামগুলোর মানুষরা মাছ-কাঁকড়া ধরা, গোলপাতা কাটা ও মধু আহরণের কাজ করেন।
সরেজমিনে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতা বোঝাই বড় বড় নৌকা। বাওয়ালিরা কেটে আনা গোলপাতা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে সাজিয়ে রাখছেন।
তবে এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হলেও একেকটি নৌকায় দুই থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা বোঝাই করা।
একইসঙ্গে নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার নিচেও রয়েছে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।
তবে বাওয়ালি-মহাজনরা বলছেন, সুন্দরবনের বনজ সম্পদ আহরণে পদে পদে ঘুষ লাগায় ক্ষতি পোষাতে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠ বোঝাই করতে বাধ্য হন। বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের টাকা না দিলে বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
কয়রা নদীর পাড়ে নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে কয়েকজন বাওয়ালি বলেন, এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ব্যবসা নেই। কারণ বনদস্যুদের চাঁদা আর সরকারি রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের।
পাশাপাশি রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। গোলপাতার ঝাড়ের মধ্যে বাঘ লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা থাকে। এরপরও জীবিকার তাগিদে বনে এ পাতা কাটতে যেতে হয়।
বাওয়ালি আবদুস সালাম বলেন, ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সাকল্যে সরকারি রাজস্ব আসে ১২ হাজার টাকার মতো। লোকালয়ে আনার পর এক কাউন (১৬৮০টিতে এক কাউন) ভালো গোলপাতা ৩২০০ টাকা বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, “বন অফিস থেকে অনুমতি নেওয়ার সময় বন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত টাকা বখশিশ, এরপর কুপে তল্লাশি, ঘের দেওয়া, ঘাটে তল্লাশি, সিটি কাটানোসহ (পারমিট হস্তান্তর) বিভিন্ন অজুহাতে সব মিলিয়ে অতিরিক্ত ঘুষ দিতে হয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
“তার ওপর সুন্দরবনজুড়ে বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাত। তাদেরও চাঁদা দিতে হয়।”
সালাম বলেন, এসব টাকা দিতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়ছেন তারা। এ কারণে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠ বোঝাই করতে বাধ্য হয়েছেন।
সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপের সুতারখালী এলাকার বাওয়ালি-মহাজন আবু মুছা সানা বলেন, “এমনিতেই গোলপাতার চাহিদা কমে গেছে। তারপর পদে পদে এত টাকা দিয়ে ব্যবসা করা যায় না। অনেক বনজীবী লোকসানে পড়ে গোলপাতার ব্যবসা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমিও আগামী মৌসুমে আর গোলপাতা কাটতে সুন্দরবনে নৌকা ঢুকাবো না।”
তবে নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয় জানা নেই বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।
তিনি বলেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক সব ধরনের অপরাধ দমনে সচেষ্ট রয়েছেন বন কর্মকর্তা ও রক্ষীরা। এ ধরনের কাজে বন বিভাগের কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
বনদস্যুদের উৎপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, “ভুক্তভোগী এমন কোনো বনজীবী এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বনদস্যুদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কথা শুনেছি।
এ বিষয়ে কোস্ট গার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান বলেন, “৫ অগাস্টের পর সুন্দরবনসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে ২২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হান্নান বাহিনীর প্রধান হান্নানকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় তালিকাভুক্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”