আরও ১০ জন রেংমিটচ্যভাষী ম্রো থাকতে পারে বলে ২০১৪ সালে জানা গেলেও তাদের এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Published : 01 Feb 2023, 05:06 PM
বান্দরবানে ম্রো জনগোষ্ঠীর ‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারাদের মধ্যে জীবিত রয়েছেন মাত্র ছয় জন। যাদের অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব বয়সের। ‘রেংমিটচ্য’ জানা এই মানুষরাও মূলত ম্রো ভাষায় কথা বলেন, এমনকি তারা সবাই একই এলাকার বাসিন্দা না হওয়ায় এই ভাষা চর্চার সুযোগও তাদের তেমন হয় না।
তাই ভাষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ মানুষগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আরেকটি ভাষা।
রেংমিটচ্যভাষী এই ছয়জন ম্রো হলেন- আলীকদম সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ক্রাংসিং পাড়ার বাসিন্দা মাংপুং ম্রো (৬৯), একই পাড়ার বাসিন্দা কুনরাও ম্রো (৭২), একই পাড়ার বাসিন্দা আরেক কুনরাও ম্রো (৬২) এবং নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)।
অন্য দুজন হলেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুং ম্রো (৫৪) ও সাংপ্ল পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৫)।
তার মধ্যে মাংপুং ম্রো, রেংপুং ম্রো ও মাওয়াই ম্রো তারা আপন ভাই। জীবিত এই ছয়জনের মধ্যে দুজন নারী।
তবে বিলুপ্তপ্রায় এই ‘রেংমিটচ্য’ ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় ‘মিটচ্য তখক’ নামের এই বইটিতে রেংমিটচ্য ভাষার উচ্চারণ ম্রো শব্দের পাশাপাশি লেখা হয়েছে বাংলা শব্দের মাধ্যমে।
বইটির লেখক ও ম্রো ভাষার লেখক ইয়াঙান ম্রো জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রেংমিটচ্য ভাষার শব্দ সংগ্রহ করে তিনি বইটি প্রকাশ করেছেন। রেংমিটচ্যভাষী জীবিত ছয়জনের ছবি দিয়ে বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে।
আর খবর পেয়ে আলীকদমের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)।
বইয়ের প্রচ্ছদে নিজের ছবি দেখে আপ্লুত হয়ে থোয়াই লক ম্রো সাংবাদিকদের বলেন, “বিলুপ্তপ্রায় একটি ভাষার শব্দ নিয়ে বই প্রকাশিত হবে কল্পনাও করিনি। ইয়াংঙান ম্রো আমাকে ২০টি বই দিয়েছে। গিয়ে সবাইকে দেখাব। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া আমার এক নাতির জন্য বেশি খুশি হয়েছি। সে বাংলার মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা শিখতে পারবে।”
বইটির লেখক ইয়াঙান ম্রো জানান, মূলত ২০০৯ সালে বান্দরবান জেলার আলীকদমে এসে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ডেডিভ পিটারসন।
তিনিই প্রথম ম্রোদের মধ্যে রেংমিটচ্যভাষীদের খুঁজে বের করেন। তার সেই গবেষণার সহযোগী ছিলেন ম্রো ভাষার লেখক ইয়াঙান।
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইয়াঙান ম্রো বলেন, “২০০৯ থেকে ২০১০ সালের দিকে ডেভিড পিটারসন রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২২ জনকে খুঁজে বের করেন। বিভিন্ন সময় মারা যাবার পর যাদের মধ্যে এখন মাত্র ছয়জন জীবিত রয়েছেন।
“ডেভিড পিটারসন চলে যাওয়ার পর আমি নিজ উদ্যোগেই এ ভাষা নিয়ে কাজ করা শুরু করি। ২০১৪ সালে রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন আমাকে জানিয়েছেন, তাদের ২২ জনের বাইরে আরও ১০ জন রেংমিটচ্যভাষী ম্রো থাকতে পারে। যারা ভাল করে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন।”
এই ১০ জন রেংমিটচ্যভাষী কোন এলাকায় রয়েছেন এখনও খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ইয়াংঙান ম্রো আরও বলেন, “জীবিতদের আলীকদমের ক্রাংসিং পাড়ার বাসিন্দা মাংপুং ম্রো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।
“সদর উপজেলায় নিয়ে এসে তার ভাল চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু পরিবারে আর্থিক সংকট ও দুর্গম এলাকা হওয়ায় তারা চিকিৎসা করাতে পারছেন না।”
রেংমিটচ্য ভাষার শব্দভাণ্ডার বইটির সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইয়াংঙান বলেন, “২০১৩ সাল থেকে আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা ঘুরে রেংমিটচ্য ভাষার লোকজনদের কাছ থেকে শুনে শব্দ সংগ্রহ করা শুরু করি আমি।
“ভাষাটি যাতে বিলুপ্ত না হয় সংগৃহীত শব্দগুলো সংকলন করে এ বছর জানুয়ারিতে বই আকারে বের করা হয়েছে। ৩৭ পৃষ্ঠার এ বইটিতে মোট তিন হাজারের বেশি শব্দ রয়েছে। এ ভাষায় মাত্র ছয়জন বলতে পারলেও বইয়ের মাধ্যমে রেংমিটচ্য ভাষা সম্পর্কে অনেক মানুষ জানতে পারবে।
‘‘বইটিতে মোট ৩৫টি অধ্যায় রয়েছে। শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, তরিতরকারি, খাদ্যের নাম, খেলাধুলার নাম, দিন ও মাসের নাম স্থান রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া রেংমিটচ্য ভাষার বাক্য ও রেংমিটচ্য ভাষায় গণনাও রাখা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে মাত্র ১০০ কপি প্রকাশ করতে পেরেছি। ফেব্রুয়ারিতে আরও ১০০ কপি বের করা হবে আশা করি।”