বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে হামলা ও হতাহতের ঘটনায় আসামি হয়েছেন সাবেক মেয়র সূচনাসহ তার অনুসারী কাউন্সিলররা।
Published : 06 Sep 2024, 09:36 AM
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগের অনেক কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় নাগরিক সেবার কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।
এ কারণে ৫ অগাস্টের পর থেকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কুমিল্লা নগরবাসীকে। তারা বলছেন, ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের যাত্রা শুরুর পর থেকে কখনো এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
যদিও এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মেয়রের পদে থাকা কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কন্যা তাহসীন বাহার সূচনাকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
নাগরিক সেবা স্বাভাবিক রাখতে আত্মগোপনে থাকা কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডের দেখভালের দায়িত্ব আশপাশের ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। যদিও সেটি এখনও শুরু হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ডজন খানেকের বেশি কাউন্সিলর এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা সবাই সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার ও তার মেয়ে সূচনার অনুসারী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে হামলা ও হতাহতের ঘটনায় আসামি হয়েছেন সাবেক মেয়র সূচনাসহ তার অনুসারী কাউন্সিলররা।
সিটির নবনিযুক্ত প্রশাসক সাইফ উদ্দিন আহমেদ স্থবির হয়ে থাকা ওয়ার্ডগুলোর নাগরিক সেবা সচল করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ২৮ অগাস্ট প্রশাসকের উপস্থিতিতে প্রথম মাসিক সভায় সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড মিলিয়ে মোট ৩৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে সূচনার অনুসারী ১২ কাউন্সিলর অনুপস্থিত ছিলেন।
একাধিক কাউন্সিলর জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকার নন্দনপুর এলাকায় মাসুম মিয়া নামের এক হোটেল কর্মচারী নিহত হন। এ ঘটনায় ১৯ অগাস্ট কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় হত্যা মামলা হয়। সেই মামলায় আসামি হন সাবেক সংসদ সদস্য বাহার, সাবেক মেয়র সূচনাসহ বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর।
এখন পর্যন্ত চারটি মামলায় সাবেক মেয়র সূচনাকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় কাউন্সিলররাও অনেকেই আসামি হয়েছেন।
মামলায় আসামি হওয়া কাউন্সিলরদের মধ্যে আছেন বাহারের ‘ভাতিজা’ হিসেবে পরিচিত ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর আল আমিন সাদী, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জমির উদ্দিন খান জম্পি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সরকার মাহমুদ জাবেদ, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আজাদ হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আনোয়ার হোসেন, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল হাসান, ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী গোলাম সরওয়ার শিপন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মঞ্জুর কাদের মনি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ রায়হান আহমেদ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুস সাত্তার, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম আজাদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আমিনুল ইসলাম ইকরাম, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডেল হানিফ মাহমুদ, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের এমদাদ উল্লাহ, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শওকত আকবর এবং সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর কাউসারা বেগম সূমি।
নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছোটরা এলাকার বাসিন্দা আবু মুসা বলেন, “আমাদের ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। আমরা দ্রুত এই সমস্যার সমাধান চাই। ১৫ দিন ঘুরেও একটি নাগরিক সেবা পাইনি। মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।”
২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌয়ারা এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের ওয়ার্ড ও পাশের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দুজনই অনেক আগ থেকেই একাধিক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। এর আগেও তারা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে মাসের পর মাস কারাগারে ছিলেন। তখনও নাগরিক সেবা স্থবির হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু রহস্যজনক কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, “এখন নতুন করে মামলার আসামি হয়ে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। ৫ আগস্টের পর একদিনের জন্যও তাদের দেখা যায়নি। দুই ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা বন্ধ থাকায় মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।”
৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কামরুল হাসান বলেন, “কয়েকদিন ধরে টানা ঘুরছি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ করার জন্য। কিন্তু স্থানীয় কাউন্সিলরকে খুঁজে পাচ্ছি না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমস্যায় রয়েছি।”
১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা হেনা আক্তার বলেন, “আমার নাতির জন্মনিবন্ধন করতে কয়েকদিন ধরে কাউন্সিলর কার্যালয়ে ঘুরছি। কিন্তু সেখানে এখন নাগরিক সেবা বন্ধ। শুনলাম কাউন্সিলর নাকি পলাতক।”
সূত্র জানায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৮ অগাস্ট সিটি করপোরেশনের প্রশাসক সাইফ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়া উন্নয়নমূলক কাজ, ট্রেড লাইসেন্স, নাগরিক সনদ, জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যুসনদসহ যাবতীয় নাগরিক সেবায় ভোগান্তির বিষয়টি আলোচনায় স্থান পায়।
সভায় ২৭ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ১২ জন উপস্থিত ছিলেন না। তবে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সব কাউন্সিলর উপস্থিত ছিলেন। যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরও কয়েকজনের নামে ৫ অগাস্টের পরে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সভায় উপস্থিত বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত একাধিক কাউন্সিলর বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হামলা ও মিছিলে গুলি চালিয়ে হতাহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার আসামিও ওই সভায় যোগ দেন। এতে অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখন সমালোচনা চলছে।
ওই সভায় মামলার আসামিদের মধ্যে উপস্থিত থাকা নগরীর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মঞ্জুর কাদের মনি সাংবাদিকদের বলেন, “এখন পর্যন্ত আমাকে তিনটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। আমি নাকি ছাত্রদের মিছিলে হামলা করেছি। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এত সমস্যার পরও আমি নাগরিক সেবা সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
এদিকে, সভায় উপস্থিত হয়ে স্বাক্ষর করেই বের হয়ে যান সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাউছারা বেগম সুমি।
তিনি বলেন, “সভায় উপস্থিত থাকার পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। আমাকে মিথ্যা অভিযোগে দুটি মামলায় জড়ানো হয়েছে। তবু বর্তমানে নাগরিক সনদ ও প্রত্যয়নপত্র দেওয়া অব্যাহত রেখেছি। নারী কাউন্সিলরদের মধ্যে আমাকেই শুধু আসামি করা হয়েছে। অথচ আন্দোলনের সময় আমি রাস্তায়ই বের হয়নি। আমার বিশ্বাস, সঠিক তদন্ত হলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব।”
নগরীর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর মোহাম্মদ একরাম হোসেন বাবু জানান, অনুপস্থিত কাউন্সিলরদের এলাকায় চলমান উন্নয়ন কাজ তদারকি করার জন্য কাউন্সিলরদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এরই মধ্যে কমিটির সদস্যরা তাদের কাজ শুরু করেছেন।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, “২৮ অগাস্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, নাগরিক সেবায় ভোগান্তি নিরসনে অনুপস্থিত বা আত্মগোপনে থাকা কাউন্সিলরদের পরিবর্তে বিধি মোতাবেক পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে যারা আত্মগোপনে আছেন, তাদের ওয়ার্ডে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি দূর হবে।”
আত্মগোপনে থাকা কাউন্সিলরদের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০১২ সালে কুমিল্লা সিটির প্রথম নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজল খানকে হারিয়ে নাগরিক কমিটির ব্যানারে মেয়র হন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। ২০১৭ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সাক্কু নৌকার প্রার্থী আফজল খানের কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করেন।
২০২২ সালের ১৫ জুন তৃতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মেয়র রিফাত। গত ৯ মার্চ এ সিটির উপনির্বাচনে বাহারের মেয়ে সূচনা দুইবারের মেয়র সাক্কুকে হারিয়ে নির্বাচিত হন।
মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ১৯ অগাস্ট সরকারি এক আদেশে তিনি অপসারিত হয়েছেন। বর্তমানে সূচনা ও তার বাবা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার পলাতক রয়েছেন।