তিন বছর আগে তাদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
Published : 26 Feb 2025, 11:16 PM
বাংলাদেশকে ভালোবেসে সুদূর ইতালি থেকে আসা দম্পতি মানবসেবায় কাটালেন দীর্ঘ ৫০ বছর।
বুধবার তাদের দুজনের বাংলাদেশে আগমনের ‘গোল্ডেন জুবলি’ উদযাপন করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার সদর তালা উপজেলা সীমান্তের গোপিনাথপুরের ঋশিল্পীপল্লী ভিনসেনজো ফালকনে ও গ্রাজিয়েল্লা মেলানো লাওরা
দম্পতিকে শুভেচ্ছায় মঙ্গলবার থেকে সেজেছে অন্যরূপে।
পঞ্চাশ বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানে ছিল কেক কাটা, আলোচনা, নাচ-গানে এক রঙিন উৎসব।
একই পল্লীতে তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিবন্ধী আশ্রমে ছিল বিশেষ খাবারের পরিবেশনা।
ইতালিয়ান দুই নারী-পুরুষ অন্য দৃষ্টান্ত হয়ে এদেশে দুঃখ-কষ্টে থাকা বিবর্ণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন অভিভাবক।
ভিনসেনজো ফালকনে ও গ্রাজিয়েল্লা মেলানো লাওরাকে তিন বছর আগে সাতক্ষীরার তৎকালীন ডিসি মো. হুমায়ুন কবির দিয়েছেন সম্মানসূচক নাগরিকত্ব।
মো. হুমায়ুন কবির বর্তমানে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।
ফোনে তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “যারা মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে তারা অবশ্যই মহান। ভিনসেনজো ফালকনে ও গ্রাজিয়েল্লা মেলানো লাওরা দুই বন্ধু কিন্তু মানবতায় নিবেদিত প্রাণ এক অসাধারণ দম্পতি। তাদের নাগরিকত্ব প্রদান বাংলাদেশকে নয়, মানবতাকে সম্মানিত করেছে।”
অসংখ্য স্কুল-স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, দরিদ্রদের আশ্রয়-আশ্রম, কর্মসংস্থান, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছেন ৫০ বছর আগে ইতালি থেকে আসা দুই তরুণ-তরুণী।
এসব কাজে প্রচলিত ধরনের দাতাসংস্থা নেই দাবি করে ভিনসেনজো ফালকনে-গ্রাজিয়েল্লা মেলানো লাওরা বলেন, ঋশিল্পী ফাউন্ডেশন নামে ব্যবসা পরিচালনা করেন তারা। যেখানে চামড়া ও পাটজাত ও গমের খড়ের কুটিরশিল্প থেকে উৎপাদিত পণ্য তারা দেশে-বিদেশে রপ্তানি করে অর্থের সংস্থান করেন।
এছাড়া আছেন তাদের ইতালিয়ান কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী ।
বিদেশি এ দম্পতির সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, পঞ্চাশ বছর আগে আট সহস্রাধিক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ত্রিশের দুই তারুণ্য ইতালি থেকে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারে।
পরে বাংলাদেশের মানুষের প্রেমে পড়ে নেমে যান মানবতার কাজে।
আর দেশে ফিরে না যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে দুজন দম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৫ থেকে কেটে গেল ৫০টি বছর।
৫০ উদযাপনে অংশ নিতে ইতালি থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদের শেষ জেলা সাতক্ষীরায় এসেছেন তাদের বন্ধু মনিকা টুসি, লেল্লা, লিসিয়ানা, লুকা, লুইসা, আদা ও নাজারিও।
ঋশিল্পীপল্লীতে তাদের ঘিরে এ আয়োজনে আপ্লুত আশি ঊর্ধ্ব ভিনসেনজো ফালকনে।
তাদের নিয়ে উপস্থিত অনেকে কথা বললেও আবেগে অশ্রুসিক্ত ফালকন ছিলেন চুপ।
মানুষের জন্য এতো কিছু করার পরও তারা প্রচারে জড়াননি।
এই দম্পতির পরিশ্রমে গড়া প্রতিবন্ধী আশ্রমের শিশুদের অনেককে এনেছেন রাস্তা থেকে।
এখন শিশুরা প্রত্যেকে তাদের সন্তানের নাতি-নাতনির মত।
আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী হাজার হাজার নারী-পুরুষের কাছে তারা দুজন বাবা-মা।
ইতালি থেকে আসা বন্ধু লিসিয়ানার ভাষ্য এমন, এনসো-লাওরারা পৃথিবীতে বিরল। সাধারণত আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে কেউ এরকম অনুন্নত দরিদ্র মানুষের মাঝে মিশে যাওয়া এবং সেই দেশের নাগরিক হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া দুঃসাধ্য সাধনের মত।
সাতক্ষীরা শহরের সফুরুনেসা মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, “আশি ঊর্ধ্ব এই নর-নারী সাতক্ষীরার লাখ লাখ মানুষের সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের সব থেকে বড় যত কাজ আছে, তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষার প্রসার, দেশের উপকূলীয় এই জেলার মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে লাখ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে দিচ্ছেন সুপেয় পানি। আমরা তার বাংলাদেশের মানুষের সেবার পঞ্চাশ বছরকে স্মরণ করি কৃতজ্ঞ চিত্তে।”
সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদ্য সাবেক সদস্যসচিব আব্দুল আলীম বলেন, “পরোপকারী ও মানবসেবার বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী এ দম্পতি।”
তিনি এ ইতালিয়ান দম্পতির সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন কামনা করেন।