রমজানে ব্যক্তির ছবিসহ বিজ্ঞাপন সরাতে সিলেট সিটির বিজ্ঞপ্তি, সমালোচনা

‘ধর্মকে ব্যবহার করে’ মেয়র নিজের ‘ভোট ব্যাংক’ নিশ্চিত করতে চাইছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2023, 11:16 AM
Updated : 15 March 2023, 11:16 AM

‘রমজানের পবিত্রতা রক্ষায়’ ব্যক্তির ছবিসহ ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড সরিয়ে নেওয়ার জন্য সিলেট সিটি করপোরেশন একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে; এ নিয়ে নগরীজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

সোমবার সিলেটের কয়েকটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান স্বাক্ষরিত এ বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়।  

সামনে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতাদের নগরবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর প্রবণতার মধ্যে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল।

এর সমালোচনা করে অনেকেই বলছেন, এই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র আসন্ন নির্বাচনে আলোচনা থাকায় ‘উপলক্ষ’ তৈরি করেছেন। ‘ধর্মকে ব্যবহার করে’ মেয়র নিজের ‘ভোট ব্যাংক’ নিশ্চিত করতে চাইছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

কারো মতে, এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি ব্যক্তির স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে, সিটি করপোরেশনের তা দিতে পারে না।

সিটি করপোরেশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা রয়েছে- “এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকল নাগরিক ও বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যতা রক্ষায় সিলেট সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী বোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, গাড়ির বডিসহ যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচারে কোনো ব্যক্তির ছবি ও কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন প্রচার না করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।

“যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী বোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, কিংবা অন্যকোনোভাবে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তাহলে তা অনতিবিলম্বে অপসারণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।“

বুধবার দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছর রমজানের আগে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়; এ বছরও হয়েছে। মূলত রমজান মাসে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ছবিসহ বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্য এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া রমজানের ভাবমূর্তি রক্ষায় ছবিসহ ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড না দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।“

সামনে ঈদ ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান মেয়র বা আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতারা তোরণ, পোস্টার, বিলবোর্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা পারবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মতিউর বলেন, “আইনগতভাবে কেউ এটা করতে পারবেন না।”

তবে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়ে নির্ধারিত স্থানে কর পরিশোধ করে প্রচার চালাতে পারবেন বলে জানান প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা।

বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সিটি করপোরেশনের এ রকম বিজ্ঞপ্তি দেওয়া ঠিক হয়নি।”

বুধবার নগরীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক বিভাজকের মাঝে, রাস্তার পাশে আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক বিভিন্ন দলের নেতারা প্রচারের জন্য পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড টানিয়েছেন। কেউ কেউ নগরবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েও প্রচার চালিয়েছেন। মানুষের বাড়ি, বিভিন্ন অফিসের দেয়ালও ছেয়ে গেছে পোস্টারে। গোটা নগরী এ ধরনের প্রচার-সরঞ্জামে ঠাসা।

গত ১০ মার্চ বিএনপির সিলেট নগর কমিটির সম্মেলন হয়েছে। সেই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং সম্মেলনের সফলতা কামনা করে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিএনপি নেতা মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নামেও ব্যানার, বিলবোর্ডের মাধ্যমে প্রচার চালানো হয়েছে। বিএনপির আরও অনেক নেতাও একই রকম প্রচার চালিয়েছেন।

অবশ্য বুধবার দুপুরে অন্য নেতাদের সেসব প্রচার-সরঞ্জাম দেখা গেলেও মেয়রেরগুলো আর দেখা যায়নি। স্থানীয় কয়েকজেনর সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, সেসব ব্যানার-বিলবোর্ড খুলে নেওয়া হয়েছে।  

বিজ্ঞপ্তিটি প্রচারের পর অনেকেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি প্রকাশ করে নিজের মন্তব্য জুড়েছেন।

অনলাইন পোর্টাল সিলেটটুডে’র প্রধান সম্পাদক কবির য়াহমদ লিখেছেন, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী “ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘পবিত্র রমজানের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যতা রক্ষা’! সিলেটবাসীকে ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখাচ্ছেন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ আর সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার এক আসামি।“

পরিবেশ সংগঠক আব্দুল করিম কিম লিখেছেন, “রমজানের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে সিলেট সিটি করপোরেশন যেকোনো ব্যক্তির ছবি ও কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন সম্বলিত বিলবোর্ড অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে। এখানে যেকোনো ব্যক্তি বলতে 'কবি' আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন? কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন না হয় বোঝা গেল। নারীর ছবি সম্বলিত বিজ্ঞাপনকে 'কবি' রমজান মাসে কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন মনে করেন?”

“আসলে এই জরুরি বিজ্ঞপ্তি রমজানের জন্য নয়। এ হচ্ছে মেয়র মহোদয়ের বিতর্ক সৃষ্টি করে আলোচনায় থাকার কৌশল। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার করা তিনি শুরু করেছেন। এখন এই বিজ্ঞপ্তির পক্ষে-বিপক্ষে কথা হবে। পক্ষে যারা বলবেন, মেয়র আগামী নির্বাচনে তাদেরকে ভোট ব্যাংকের নিশ্চিত ভোটার হিসাবে পেয়ে যাবেন।”

সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু লিখেছেন, “স্টুডিওর উপরে সাইনবোর্ডের একপাশে লেখা রয়েছে, ‘ছবি তোলা হারাম- আল খোমেনি’। আর আরেক পাশে বড় করে খোমেনির ছবি দেওয়া। আবুল বাশারের কোনো একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম এমন। আমাদের মেয়রও ওই স্টুডিও মালিকের মতো। শহরজুড়ে নিজের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েও ছবিসহ বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন। আর বিলবোর্ডে ঝুলে থাকা ছবি থেকে তো বৈধ-অবৈধভাবে টাকা কামাই করে চলছেনই। অথচ ছবির প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তিনি।”

তবে এসব বিষয় নিয়ে চেষ্টা করেও মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা জানান, তিনি অসুস্থ। উন্নত চিকিৎসার জন্য বুধবার তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।