অসুস্থতা নিয়েও অভাবের সংসারে পরিবারকে সাহায্য করতে তিন বছর ঢাকায় ফুটপাতে কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন হৃদয়।
Published : 28 Nov 2024, 09:32 AM
ছেলের কবরের টানে প্রথম দুই মাসে ঝালকাঠি থেকে চারবার ঢাকা যান হৃদয়ের বাবা। এখন পরিবার নিয়ে ঝালকাঠিতেই থিতু হয়েছেন। ঘরে বৃদ্ধ মা, পুত্রশোকে পাথর স্ত্রী, অসহায় সন্তানদের কথা ভেবে আর ঢাকায় যেতে পারেন না। দেখা হয় না ছেলের কবরখানাও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুরে গুলিতে নিহত হন ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেখেরহাট ইউনিয়নের শিরযুগ গ্রামের শহিদ হাওলাদারের ২০ বছর বয়সি ছেলে হৃদয় হাওলাদার।
ওইদিন সন্ধ্যায় হৃদয়ের সঙ্গে থাকা তার ১৮ বছর বয়সি চাচাত ভাই রিফাতও গুলিবিদ্ধ হন।
পরে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে হৃদয়কে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
রাতেই হৃদয়ের লাশ ঝালকাঠিতে আনার চেষ্টা করেও নানা বিপত্তির মুখে ব্যর্থ হয়ে পরদিন ভোরে ঢাকার কালশি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী বাবা শহিদ হাওলাদার বলেন, তার ছেলে বক্ষব্যাধি রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
কয়েক দফায় ঢাকার মহাখালী বক্ষব্যাধি, বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইসলামিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
অসুস্থতা নিয়েও অভাবের সংসারে পরিবারকে সাহায্য করতে তিন বছর ঢাকায় ফুটপাতে কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন হৃদয়।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার শিরযুগ মডেল স্কুলের পেছনে তাদের কাঁচামাটিতে ভাঙা ঘর।
সম্প্রতি সেখানে গেলে দূর থেকে শোনা যায়, হৃদয়ের ছোট দুই ভাই-বোনের কান্নার আওয়াজ।
ভাইকে হারিয়ে ১৬ বছর বয়সি রিয়াদ আর পাঁচ বছর বয়সি মরিয়ম সারাক্ষণ ‘ভাইয়া-ভাইয়া’ বলে কাঁদে।
শোক প্রকাশের মত কাউকে পেলেই বুকভাঙা আহাজারি করেন মা আর বৃদ্ধা দাদি।
ঘরের আঙিনায় বসে মা কুলসুম বেগম বলেন, “আমার হৃদয় টাকা আয় করত কিন্তু একটা ভালো জামা গায়ে দিত না। অসুস্থ অবস্থায়ও বিছানায়ও থাকে নাই। শেষবার ঢাকা যাওয়ার আগেও কইছে- মা, আমরা ৪-৫ লাখ টাকা দেনা হইছি- কেমনে রেস্টে থাকমু।”
বুকভেজা আহাজারির সঙ্গে দাদি আনোয়ারা বেগমের বারবার একই কথা, “আমার দরদ, আমার ভাই ছাড়া আর কেডা বোঝব? আল্লায় আমারে নিয়া যদি আমার ভাইরে বাঁচাইয়া রাখত!”
ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বরে একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি করেন হৃদয়ের চাচা ইমাম হাওলাদার। ওই বাড়িতে তার জন্য বরাদ্দ হয় থাকার জায়গা।
মোবাইলে কথা হয় ইমাম হাওলাদারের সঙ্গে।
তিনি বলছিলেন, তার ভাতিজা অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার আগে যখন এই এলাকায় ফুটপাতের দোকানে চাকরি করতেন, তখন তার কাছেই থাকতেন।
নিজের দুই ছেলে শিমুল ও রিফাত তার একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা চালায় সময় ভাগ করে।
ইমাম হাওলাদার বলেন, ঘটনার মাত্র সাত দিন আগে অর্থাৎ ১২ জুলাই ঝালকাঠি থেকে সপরিবারে ঢাকায় আসেন হৃদয়। ওঠেন তার ওখানেই।
এদিকে চলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার এক দফার আন্দোলন।
ঘটনার দিন ১৯ জুলাই সন্ধ্যার দিকে ১৮ বছর বয়সি চাচাতো ভাই রিফাতকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে যান হৃদয়।
আন্দোলনে ‘হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে’ এমন খবর জানতে পেরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে হৃদয়ের মা ফোন দিয়ে দুজনকে দ্রুত বাসায় ফেরতে বলেন।
“ফোনেই হৃদয়ের শেষ কথা ছিল, ‘মা, আমরা ছাত্র-ভাইদের সঙ্গে আন্দোলনে আছি, বাসার গেইট খোলা রাখো- এখনই চলে আসব’।”
বাবা শহিদ হাওলাদার বলেন, “এর ঘণ্টাখানেক পরই মিরপুর ৬ নম্বরের আলোক হাসপাতালের এক চিকিৎসক ফোন দিয়ে হৃদয়ের গুলি লাগার খবর দিয়ে হাসপাতালে যেতে বলেন। বাইরে অস্থির অবস্থার মধ্যেও হাসপাতালে গিয়ে মেলে হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ। গুলিতে আহত তার চাচাতো ভাই রিফাত কাতরাচ্ছে।”
দেখা যায়, হৃদয়ের লাশের ছাড়পত্রে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘গান শ্যুট ইনজুরি’ লেখা আছে।
বাবা শহিদ হাওলাদার বলেন, “ওই রাতে ছেলের লাশ ঝালকাঠিতে নিতে চাইলেও কোনো অ্যাম্বুলেন্সের চালক রাজি হননি। পরদিন ছিল কারফিউ। রাতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে মরদেহ নেওয়া হল মিরপুর ১১ নম্বরে ভাইয়ের ওখানে। সে রাতেই গোসল করিয়ে রাখা হয়। ফ্রিজিং গাড়ি ভাড়া করে সারারাত লাশ রাখা হয়।”
শহিদ বলেন, ফজরের নামাজের পরে শ’খানেক মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে ছেলের লাশ নেওয়া হয় ঢাকার কালশি গোরস্থানে। দাফন করা হয় অনেক ভয়-ভীতি মাথায় নিয়ে।
স্বজনরা জানান, হৃদয়ের স্বপ্ন ছিল পরিবারের পাঁচ লাখ টাকার ঋণ শোধ করবে। ঘরের টিনের চালা দিয়ে যেন আর বৃষ্টির পানি না পড়ে, তেমন একটি সুন্দর ঘর বানাবে।
নিজে পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়তে না পারলেও ছোট দুই ভাই-বোনকে পড়ালেখা করানোর স্বপ্ন ছিল তার।
বাবাকে যেন আর রাজমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে দিনের পর দিন না খাটতে হয়, তার স্থায়ী ব্যবস্থার জন্যও ভাবতেন। কিন্তু হৃদয়ের বুকে লাগা গুলি সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে।
হৃদয়ের পরিবারকে জেলা জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে স্বজনরা জানান।
এ ছাড়া ২৩ নভেম্বর বরিশাল বিভাগে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়েছে হৃদয়ের বাবার হাতে।
শহিদ হাওলাদার বুকে চাপা কান্না নিয়ে বলেন, “আমার বাবা কালশীর গোরস্থানে পড়ে আছে, এই টাকা দিয়া আমি কী করমু!”
এদিকে, নিহত হৃদয়ের চাচাত ভাই গুলিবিদ্ধ রিফাত এখনও বিছানায় কাতরাচ্ছে।
মোবাইল ফোনে ইমাম হাওলাদার বলেন, ঘটনার প্রথম রাতে হাসপাতালের চিকিৎসক রিফাতের মাথা থেকে কয়েকটি ছররা গুলি বের করে ব্যান্ডেজ দেন।
ভয়-ভীতির মধ্যে ছেলেকে নিয়ে রাতেই বাসায় চলে যান। তখনও রিফাতের মাথা ও গলার বাঁ দিকে তিনটি বুলেট থেকে যায়।
ওইদিন থেকে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ১৬ দিন বাসায় চিকিৎসা চলে।
কিন্তু খেতে গেলে শ্বাসনালীতে কষ্ট পায় রিফাত। এ ছাড়া স্বাভাবিক আচরণেও পরিবর্তন আসে তার। চুপচাপ বসে থাকে। সব কিছুতে সাড়া দেয় না। দুই ভাই একই দিনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ভুলতে পারছে না সে।
ইমাম হাওলাদার বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে মাথার একটি গুলি বের করা হয়। অক্টোবরে একই কায়দায় আরেকটি গুলি বের করা হয়। তবে শ্বাসনালীর পাশের গুলিটি এখনই বের করতে নারাজ চিকিৎসক।
তার দাবি, চিকিৎসার ব্যয়ভার জামায়াতে ইসলামী বহন করলেও রিফাতের ওষুধের জন্য প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় ৩০০ টাকা। এর বাইরেও ছেলের জন্য প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার।