Published : 20 Apr 2024, 09:40 AM
ইতোমধ্যে কৃষি পর্যটন উপজেলা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সিলেটের গোলাপগঞ্জ। বছরজুড়েই প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকরা পাহাড়-টিলাঘেরা কৃষি বাগান দেখতে ভিড় করছেন উপজেলাটিতে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাশরেফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উপজেলার ৪০টি পাহাড়-টিলায় গড়ে উঠেছে আনারসের বাগান। সঙ্গে মাল্টা, কাজুবাদাম, কফি, কমলা ও লেবুর উৎপাদন হচ্ছে।
“ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আনারস বাগান ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। পর্যটকরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন বাগান দেখতে আসছেন গোলাপগঞ্জে।”
তিনি বলেন, “কৃষি বিভাগ চেষ্টা করছে এই উপজেলাকে পুরোপুরি কৃষি পর্যটন উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলতে। পুরো উপজেলায় আট শতাধিক পাহাড়-টিলা বিভিন্ন প্রজাতির কৃষি বাগানের আওতায় আনার কাজ অব্যাহত রেখেছে কৃষি বিভাগ।”
মাশরেফুল আলম আরও বলেন, কৃষি বিভাগের আওতাধীন বাগানগুলোতে আনারস উৎপাদনে কোনো প্রকার কৃত্রিম হরমোন ও ভিটামিনের ব্যবহার হচ্ছে না। ফসলের পাশাপাশি পর্যটকদের আগমনে এলাকার কৃষক ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেট অঞ্চলের সব টিলা-পাহাড়কে ‘ফলের টিলায়’ পরিণত করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে; ফলে আমাদের ফল আমদানি কমবে।”
তিনি আরও বলেন, “টিলা-পাহাড়ে ফলের বাগান করায় একদিকে কর্মসংস্থান ও কৃষকের আয় যেমন বাড়বে, তেমনি টিলা সংরক্ষণ হবে। সিলেটের আনারস বাগানের টিলার সৌন্দর্য বেড়ে যাওয়ায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। আগের থেকে বেশি পর্যটক যাচ্ছেন বাগান দেখতে।”
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলার ১৯৬ হেক্টর জমিতে ৪৪টি বাগানে এক হাজার ৬১০ টন আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল এক হাজার ৫৬০ টন। এছাড়াও আনারস বাগানে মাল্টা, লেবু, কফি ও কাজুবাদামের আবাদ করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগ আরও জানায়, সিলেটে অন্তত দুই হাজার ৬৬টি পাহাড়-টিলা রয়েছে। এসব টিলা লেবু, কমলা জাতীয় ফসল, কফি, কাজুবাদাম ও আনারস চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
পতিত বা অনাবাদি টিলাগুলো ফসলের আওতায় আনতে কৃষি বিভাগ দেশবিদেশে বসবাসরত টিলার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাদের নিজ নিজ টিলা আবাদযোগ্য করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। অনেকে সাড়াও দিচ্ছেন। কৃষি বিভাগ আগ্রহীদের পরামর্শের পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা করছে।
আনারসের মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ
সম্প্রতি গোলাপগঞ্জ উপজেলার দত্তরাইল গ্রামে ‘ভাই ভাই আনারস বাগানে’ গিয়ে দেখা যায়, উঁচু-নিচু টিলার ভাঁজে-ভাঁজে গাছে গাছে ধরে আছে কাঁচা-পাকা আনারস। পাকা আনারসের মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা চারপাশ; সঙ্গে আছে সবুজের সমারোহও।
বাগানে কাজ করা শ্রমিকেরা গাছ থেকে পাকা আনারস তুলছেন। টিলার কোথাও কোথাও আনারস কেটে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
ঘুরতে আসা কেউ কেউ সেখান থেকেই আনারস কিনে ব্যাগ ভরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।
বাগানটির মালিক মো. শাহজাহান আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাগানে আটজন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন; তবে সিজন টাইমে শ্রমিকের সংখ্যাটা দাঁড়ায় আরও বেশি।”
গত তিন বছর ধরে আনারস উৎপাদন করা শাহজাহান জানান, ১২ কেয়ার (এক কেয়ার সমান ৩০ শতাংশ) টিলায় তিনি রোপণ করেছেন সিলেটের স্থানীয় জাতের জলঢুপি আনারস।
এসব আনারস কৃত্রিম হরমোন ও রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় প্রচুর মিষ্টি দাবি করে শাহজাহান বলেন, “এজন্য ক্রেতা সমাগত প্রতিদিনই বাড়ছে।”
গেল বছর প্রায় ২০ লাখ টাকার আনারস বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করছি, এ বছর ৩০ লাখ টাকার আনারস বিক্রি হবে।”
তিনি জানান, তার বাগানের আনারস ৫০০ টাকা হালি থেকে শুরু করে ৮০-৬০ টাকা হালি দরেও বিক্রি হয়। পর্যটকরা প্রতিদিনই তার বাগানে ঘুরতে আসেন তবে বাগানে প্রবেশে পর্যটকদের কোনো টাকা লাগে না।
এলাকার বাসিন্দা নূর মিয়া জানান, জলঢুপি আনারস স্থানীয়ভাবে খুবই পরিচিত। এই আনারস খেতে মিষ্টি হয়।
তিনি বলেন, “এলাকায় যাদের টিলা আছে তাদের অনেকে বাগান চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন। কারণ, এতে ফসল উৎপাদন ও পর্যটন বাড়বে। একইসঙ্গে টিলার মালিকেরা লাভবান হবেন।”
বাড়ছে পর্যটকদের আনাগোনা
‘ভাই ভাই আনারস বাগান’ থেকে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে দেখা মিলবে ১২০ কেয়ার টিলা-পাহাড়ে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন ‘চাঁন মিয়া পাইনাপেল গার্ডেনে’র।
বাগান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালে এই বাগানে আড়াই লাখ আনারসের গাছ লাগানো হয়েছিল। সঙ্গে আছে মাল্টা, লেবু, কাজুবাদাম ও কফি গাছ।
দর্শনার্থীদের জন্য একটি টিলার চূড়ায় তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক, ওয়াকওয়ে ও বসার স্থান। সিঁড়ি বেয়ে টিলার উপরে উঠলে দেখা মিলবে চারপাশে সবুজের বিশাল সমারোহ।
বসার ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে দুই টিলার ঢালেও। রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফুলের টবও। ছবি তোলা বা দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য দেখার স্থানও রাখা হয়েছে বাগানটিতে।
তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় লেগেই থাকে চাঁন মিয়া পাইনাপেল গার্ডেনে।
দত্তরাইল গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুল মতিন চাঁন মিয়ার নামে গড়ে তোলা এই বাগানের পরিচালক হিসেবে আছেন তার নাতি কাউসার রেজা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের পরিবারের আট সদস্য যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বিয়ানীবাজারের এক ব্যাংক কর্মকর্তার পরামর্শ পেয়ে নিজেদের টিলাগুলোতে আনারসের বাগান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।
কাউসার রেজা বলেন, “আমাদের বাগানের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে আছেন রইছ উদ্দিন আহমদ। বাগান তৈরি করতে প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল; তবে সেই টাকা উঠে গেছে। ”
তিনি জানান, বাগানে আনারসের পাশাপাশি আড়াই হাজার মাল্টা গাছ, আড়াই হাজার লেবু, এক হাজার ৫০০ কাজুবাদাম, ৫০০ কমলা গাছ, ৭০০ আম গাছ, পেয়ারা ২০০ গাছ, বরই গাছ ৫০টা, কলাগাছ ৫০০ ও বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ আছে ৩০০টি।
চার বছর হয়ে যাওয়ায় আনারসের পুরোনো গাছ তুলে নতুন করে দেড় লাখ চারা লাগানো হয়েছে। নতুন আনারস গাছে ১৪ থেকে ১৮ মাস পর ফল আসবে।
চাঁন মিয়া পাইনাপেল গার্ডেনে ৩০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হয় জানিয়ে কাউসার রেজা বলেন, “টিলাতে বাগান করার পর উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে আমাদের ভালো আয় হচ্ছে। তবে বাগানের ৮০ ভাগ আয় আমার দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত চ্যারিটিতে দিয়ে দিই।”
আনারস বাগানে এলাকার বেকার যুবকদের কর্মস্থান হয়েছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, “বাগানে রেগুলার ১০ জন আর সিজন টাইমে ৪০ থেকে ৫০ জন লোক কাজ করেন। সারা বছরই পর্যটক আসেন বাগানের সৌন্দর্য দেখতে। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার পর্যটক বাগানে ঘুরতে আসেন।”
তার দাবি উপজেলায় সবচেয়ে বড় আনারসের বাগান এই ‘চাঁন মিয়া পাইনাপেল গার্ডেন’।
বাগানে ঘুরতে আসা শিক্ষক ও পর্যটক গোলাম সারোয়ার লিটনের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, “বাগানটি আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। পরিকল্পিত আনারসের বাগান টিলা-পাহাড়ের সৌন্দর্যও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।”
বাগান থেকে ৫০০ টাকায় দুই হালি আনারসও কিনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ ও বাগানের সুস্বাদু ফলের স্বাদ নিতে বার বার এ আনারসের বাগানে ঘুরতে আসতে চাই।”