এবার কুমিল্লায় ‘ডানা মেলছে’ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি

চা বাগানের জন্য যে পরিমাণ বৃষ্টির প্রয়োজন এখানে তার প্রায় ১০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়।

আবদুর রহমানকুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2023, 02:59 AM
Updated : 3 May 2023, 02:59 AM

সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের বাইরে পঞ্চগড়ের সমতলে বেশ আগেই চা বাগান করে সফলতা পাওয়া গেছে। তারপর গারো পাহাড়েও চা চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবার কুমিল্লায় ‘ডানা মেলছে’ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি।    

মহানগরী থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকায় আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে লালমাই পাহাড়ে গড়ে উঠেছে ‘মজুমদার চা বাগান’। কুমিল্লার প্রথম এই চা বাগানের মালিক মো. তারিকুল ইসলাম মজুমদার।  

তবে বাগান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৃষ্টি বা পানি। চা বাগানের জন্য যে পরিমাণ বৃষ্টির প্রয়োজন এখানে তার প্রায় ১০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। ফলে গভীর নলকূপ করে অতিরিক্ত পানির সরবরাহ চালু রাখতে হচ্ছে।   

২০২১ সালে চাষ করা হলেও এবারই প্রথম চা পাতা সংগ্রহ করা হচ্ছে বাগান থেকে। যদিও এখনও সেখানে কারখানার অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি।  

সম্প্রতি বাগান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লালমাই এলাকায় মাথা তুলে আছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি পাহাড়। লাল মাটির দুটি পাহাড়ে সারি সারি লাগানো হয়েছে চা চারা। মাঝে মাঝে ‘শেড ট্রি’ হিসেবে লাগানো হয়েছে সজিনা ও কড়ই গাছ। 

চৈত্রের গরমেও স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে সবুজ বাগান। কয়েকজন শ্রমিক কচি চা পাতা সংগ্রহ করছেন। তাদের কাঁধে কাপড়ের তৈরি থলে। সংগ্রহ করা কুঁড়ি ও পাতা থলেতে রাখছেন। 

পাহাড়ের উপরে বসানো হয়েছে পানির ট্যাংক। সেখান থেকে পাইপ দিয়ে শ্রমিকরা পানি দিচ্ছেন গাছের গোড়ায়।  

মজুমদার চা বাগানের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক রাজু সিং জানান, তার বাড়ি শ্রীমঙ্গলে। তার স্ত্রীও এই বাগানে কাজ করেন। তারা বংশ পরম্পরায় চা বাগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত।    

তিনি জানান, মার্চ মাস থেকে বাগানের পাতা তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে এক হাজারের কেজির বেশি পাতা তোলা হয়েছে। পাশের পাহাড়ের আরও চারা লাগানো হবে।   

চায়ের অনেক জাত থাকলেও এই বাগানে লাগানো হয়েছে বিটি-২ চারা। এটি খুব উন্নতমানের চা। এই চারা সংগ্রহ করা হয় শ্রীমঙ্গল থেকে। প্রতিটি চারার দাম ৪৫ টাকা।

রাজু সিংয়ের প্রত্যাশা, লালমাই পাহাড়েও একদিন সিলেটের মতোই চা বাগান ছড়িয়ে পড়বে। 

রাজু সিংয়ের স্ত্রী দিপালী সিং বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন।   

তিনি বলেন, “আমরা বংশ পরম্পরায় চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। মাটি দেখলেই বলে দিতে পারি, এটা কতটুকু ভালো বা খারাপ। এই মাটি খুবই উর্বর এবং চা চাষের উপযোগী। কিন্তু চায়ের ভালো উৎপাদন পেতে হলে বৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। 

“উলুসহ নানা ছত্রাক বিভিন্ন সময় চা গাছকে আক্রমণ করে। শ্রমিকদের সব সময় এই ছত্রাক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।” 

বাগান মালিক তারিকুল ইসলাম মজুমদার জানান, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার খাসিয়া সম্প্রদায়ের পুঞ্জীর মন্ত্রী জিডি সান তার বন্ধু। সেই বন্ধু একদিন লালমাই পাহাড়ের জমি এসে দেখেন। তার পরামর্শেই ২০২১ সালের মার্চে তিন হাজার চা গাছ লাগান। 

“এগুলোর গ্রোথ ভালো দেখে তিন মাস পর আরও তিন হাজার চারা লাগাই। এক একরের বেশি পাহাড়ে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি চারা রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আরও ২০ হাজার চারা লাগানো হবে। ছয় একরের বাকি জমি এখনও খালি।” 

আরও উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তারিকুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এখন হাতে চা পাতা তৈরি করছেন শ্রমিকরা। শিগগির জাপান থেকে মেশিন এনে স্থাপন করা হবে। 

মেশিন আসার আগ পর্যন্ত লালমাই পাহাড়ের এই চা ‘গ্রিন টি’ হিসেবেই খেতে হবে কুমিল্লাবাসীকে। বাগানে দুইজন স্থায়ী ও পাঁচজন অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। 

এদিকে নগরীর কাছে হওয়ায় অবসরে চা বাগানে ঘুরতে অনেকেই আসছেন। বাগান ও পাহাড় তাদের মুগ্ধ করছে বলে জানান দর্শনার্থীরা। বিশেষত ছুটির দিনে বেশি মানুষের সমাগম হয় এখানে।     

দর্শনার্থী হাসিবুল ইসলাম বলেন, “কুমিল্লার মানুষ চা বাগান দেখতে প্রতিবছর সিলেট কিংবা শ্রীমঙ্গল যায়। অনেক টাকা-পয়সা খরচ হয়। বাড়ির কাছে যদি চা বাগান থাকে, তাহলে দূরে যাওয়ার দরকার হবে না। লালমাই পাহাড়ের চা বাগানকে কেন্দ্র করে অল্প দিনের মধ্যেই বড় ধর্মপুর এলাকাটি হয়ে উঠবে পর্যটনকেন্দ্র। 

কুমিল্লার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এম এম শাহারিয়ার ভূঁইয়া বলেন, এখানে চা উৎপাদনে মাটির যে ক্ষার থাকার কথা তা রয়েছে। আমরা উদ্যোক্তাকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। তাকে দেখে আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি।   

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, কুমিল্লায় এটি প্রথম চা বাগান। এখানে বৃষ্টির পরিমাণ কম। যদি বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ে তাহলে ভালো চা হবে। 

“উদ্যোক্তা কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এখানে ভালো ‘গ্রিন টি’ হতে পারে।” 

তবে বাগানটি নিবন্ধিত নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. রফিকুল হক। 

তিনি বলেন, “কুমিল্লায় বাগান হয়েছে সেটা জানি না। নিবন্ধিত না হওয়ার ফলে আমরা এখনও সেই বাগান দেখিনি।“ 

একই কথা বলেন বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন। 

বাগানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাশাপাশি জেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বাগান করা হয়েছিল; সেটি এখন মৃতপ্রায়।” 

কুমিল্লায় বাগান করাটা অনেক চ্যালেঞ্জের ও পরিশ্রমের। এখানে প্রচুর ইরিগেশনের প্রয়োজন হবে বলে মনে করেন চা সংশ্লিষ্টরা।