স্থানীয়রা জানান, শিকার করা প্রতিটি পাখি আকার ভেদে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি হয়।
Published : 27 Dec 2024, 10:57 AM
বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে ফাঁদ পেতে ও দেশীয় যন্ত্র দিয়ে অবাধে শিকার করা হচ্ছে অতিথি পাখি এবং পরে তা বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকেও লাইভ করছেন শিকারিরা।
স্থানীয়রা বলছেন, হাওরের সংরক্ষিত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টেই শিকারিরা চুরি করে পাখি শিকার করছে দীর্ঘদিন ধরে। শীত মৌসুমে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে তৎপর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ সংগঠকরা। কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শিকারের কারণে স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে ২০০৩ সাল থেকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র আগের অবস্থায় ফেরাতে হাওর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় সরকার। ২০১৮ সালে সংরক্ষণ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন জেলা প্রশাসন কাগজে-কলমে ব্যবস্থাপনায় আছে।
কিন্তু জনবল সংকটের কারণে জেলা প্রশাসনের কোনো অভিযান বা তদারকি নেই বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের লোকজন ও পরিবেশবিদরা জানান, হাওরের বিস্তৃত জলরাশি, মাছ, গাছ, প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্রের কারণে শীতে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। বারো মাস হাওরের সংরক্ষিত বিভিন্ন কান্দায় দেশি প্রজাতির পাখিও বাস করে। হাওরের লেচুয়ামারা ও বেরবেরিয়া জলাশয় দুটি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
শীত মৌসুমে এই দুটি জলাশয় ঘেরা হিজল-কড়চ ও নলখাগড়া বনে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। জলাশয় দুটি ঘিরে বসে পাখ-পাখালির মেলা। পাখির আবাসস্থল ইকইরদাইড়, বিয়াসখালি, রৌয়া, রূপাভুই, হাতিরগাতা, চটাইন্ন্যা জলাশয় ও আশপাশের হিজল কড়চের বাগানেও পাখি গড়ে তোলে বাস্তুসংস্থান।
টাঙ্গুয়ার হাওরে পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় প্যালাসিস ঈগলসহ কালেম, পানকৌড়ি, ভূতিহাঁস, পিয়ংহাঁস, খয়রাবগা, লেঞ্জাহাঁস, নেউপিপি, সরালি, রাজসরালি, চখাচখি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা, মরিচা ভূতিহাঁস, সাধারণ ভূতিহাঁস, শোভেলার, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, ডাহুক, বেগুনি কালেম, গাঙচিল, শঙ্কচিল, বালিহাঁস, ডুবুরি, বক, সারসসহ প্রায় ২১৯ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি রয়েছে বলে জানিয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ রক্ষায় নিয়োজিত সংগঠন সেন্টার ফর নেচারাল রিসোর্স স্টাডি- সিএনআরএস।
সংস্থাটি জানায়, টাঙ্গুয়ার হাওরের ৮৮টি গ্রামে ২৮টি ভিসিজি (ভিলেজ কনজারভেশন গ্রুপ), চারটি ইউনিয়ন ভিসিজি, দুটি উপজেলা ভিসিজি ও একটি জেলা ভিসিজি ইসিএ রোল, বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ও হাওর সংরক্ষণ নীতিমালা বাস্তবায়নে স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করছে। এই নীতিমালায় পাখি শিকার নিষিদ্ধ আছে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা আছে।
সিএনআরএস এর প্রতিবেশ প্রকল্পের কর্মকর্তা শাহ কামাল বলেন, “ইউএসএআইডি ইকোসিস্টেমস-প্রতিবেশ অ্যাক্টিভিটি টাংগুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কাজ করছে। ভিসিজি পাখি সংরক্ষণে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ অব্যাহত রেখেছে। এরপরও স্থানীয় অসচেতন কিছু লোক পাখি শিকার করে বেচাকেনা করছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। এ বিষয়ে প্রশাসনিক নজরদারি প্রয়োজন।”
তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের নানা প্রজাতির জলাবন, হিজল-কড়চ, নলখাগড়ার বন কমে যাওয়া, শ্যালো মেশিনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উৎপাত, মাইক বাজিয়ে শব্দদূষণ করে পর্যটন করায় পাখি কমার অন্যতম কারণ।
সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরের লেছুয়ামারা, তেকুইন্যা, বেরবেরয়িা, হানিয়া-কলমাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শিকারিরা দেশীয় ফাঁদ দিয়ে পাখি শিকার করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের দিলোয়ার হোসেন নামের এক যুবক সম্প্রতি ‘হাওরপাড়ের মানুষ’ নামের একটি ফেইসবুক আইডি থেকে পাখি শিকারের একাধিক ভিডিও, ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করেন।
স্থানীয়ভাবে তৈরি কুচ ও দেশীয় ফাঁদ দিয়ে প্রতি বছরই পাখি শিকার করছেন তিনি। তার মতো আরো একাধিক ব্যক্তি এভাবে পাখি শিকার করে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে বলে জানান স্থানীয়রা।
হাওর পাড়ের গ্রাম জয়পুরের মৎস্যজীবী হাবিবুর রহমান বাদশা বলেন, “হাওরের পাশের বিভিন্ন গ্রামের কিছু যুবক এই সময় চুরি করে বাগান এলাকায় পাখি ধরে। প্রতিদিনই হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক টর্চ লাইটের মাধ্যমে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে। অনেকে জাল বিছিয়েও পাখি ধরে। এগুলো রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।”
মা’হদুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া চারগাঁও জয়পুর মাদরাসার পরিচালক শিহাব বিন জাহাঙ্গীর বলেন, “প্রতিদিনই টাঙ্গুয়ার হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে পাখি শিকার করছে কিছু লোক। এই পাখি অসচেতন পর্যটকরা পার্টি করে ভক্ষণ করেন। স্থানীয় রেস্টুরেন্টেও বিক্রি হয়। পাখির মাংস পছন্দ করে এমন মানুষও পাখি ক্রয় করছে। তাদেরকে থামাতে হলে প্রশাসনিক উদ্যোগ দরকার।”
স্থানীয়রা জানান, শিকার করা প্রতিটি পাখি আকার ভেদে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি হয়।
টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশকর্মী আহাম্মদ কবীর বলেন, মাছ, গাছ ও পাখিই ছিল টাঙ্গুয়ার হাওরের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য। ২০০০ সালে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওরকে বিশ্ব ঐতিহ্য রামসার সাইট ঘোষণা করে দেশি-বিদেশি সংস্থার সহায়তায় সরকার প্রকৃতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করলেও এই সংরক্ষণকালে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি আরো হয়েছে। গাছ-গাছালি কমে যাওয়া, পর্যটকদের উৎপাতসহ নানা কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরে অতিথি পাখি কমছেই।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইভ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক সোহেল শ্যাম বলেন, “এখন অতিথি পাখির আগমনের মৌসুম। সম্প্রতি দেখলাম, টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি শিকার করে ফেইসবুকে পোস্টও করছে শিকারিরা। জানতে পেরেছি, টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দেশি যন্ত্র দিয়ে পাখি শিকার করছে স্থানীয় একাধিক শিকারি। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
“বণ্যপ্রাণী আইন সংরক্ষণে আরো উদ্যোগী হতে হবে। স্থানীয় সচেতন মানুষদের সচেতন করতে নিয়মিত কর্মসূচিও চালানো জরুরি। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা করছি।”
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, “আমাদের লোকবল কম থাকায় এখন হাওরে নজরদারির জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যেতে পারেন না। কিছু আনসার আছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও সচেতন লোকজনের মাধ্যমে হাওর সংরক্ষণে আমাদের নজরদারি আছে।
“এর মধ্যেই পাখি শিকারের ঘটনা অবগত হয়ে রোববার রাতেই শিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান চালানো হয়েছে। পাখি শিকারিসহ টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও সচেতনতা প্রয়োজন।”