ঘূর্ণিঝড় রেমাল এসে ভোট থামিয়েছে ২২ উপজেলায়। নরসিংদীর রায়পুরায় ভোট আটকেছে এক প্রার্থী খুনের ঘটনায়।
Published : 29 May 2024, 08:06 AM
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে ৮৭ উপজেলায় নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা।
নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, এসব উপজেলার সাড়ে সাত হাজার কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৮টায় নির্ধারিত সময়েই ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
দুর্গম এলাকার ৪১৪ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে মঙ্গলবারই। বাকি ৭ হাজার ৩৬ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানো হয় বুধবার সকালে ভোট শুরুর আগে।
যদিও তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোটগ্রহণে তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। এরইমধ্যে ঘূর্ণিঝড় রেমাল এসে ভোট থামিয়েছে ২২ উপজেলায়। এর বাইরে নরসিংদীর রায়পুরায় ভোট আটকেছে এক প্রার্থী খুনের ঘটনায়।
আইনি জটিলতায় ভোট স্থগিত হয়েছে যশোর সদরে। আর পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সেখানে ভোটের প্রয়োজনই পড়ছে না।
উপজেলা পরিষদের প্রথম দুই ধাপে কম ভোটারের উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও তৃতীয় ধাপে এসে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সহিংসতা বেড়েছে।
একদিকে তফসিল ঘোষিত ৭৮ শতাংশ উপজেলায় ভোট হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমেছে মানুষের, অন্যদিকে আগের দুই ধাপের অভিজ্ঞতায় বুধবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও পযবেক্ষকরা।
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ নেই; শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন ভোটের দিকেই নজর রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, “সহিংসতা আমরা কোনো ধাপেই আশা করি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কমিশন, নির্বাচন পরিচালনায় যারা আছে- সবাই কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
“কেউ কোনো ধরনের সহিংসতা করে পার পাবে- তা আমরা মনে করি না। নিজেদের মঙ্গল চাইলে কোনো সহিংসতা করবেন না আশা করি।”
অনিয়মের বিষয়ে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ইসির কঠোর নির্দেশ, জাল ভোট দিলেই আইনের আওতায় আনা হবে।
“আর ভোটার উপস্থিতি কেন্দ্রে যা আসবে তাই; ফলাফলে যা বাস্তব তাই প্রতিফলিত হতে হবে। জাল জালিয়াতি প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে ভোট করার সুযোগ থাকলেও ভোটকে আরো বেশি অংশগ্রহণমূলক দেখানোর কৌশলে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা মনোনয়ন দেয়নি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফলে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও অর্ধশতাধিক উপজেলায় তাদেরও নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিন ধাপ মিলিয়ে এমন অন্তত ২১৬ জনকে দল বহিষ্কারও করেছে বিএনপি।
# এই ধাপে মোট ১ হাজার ১৫২ জন প্রার্থী রয়েছেন।
# তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৯৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৫৬ জন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৯৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
# প্রথম দুই ধাপের ভোটে বেশির ভাগ স্থানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই জিতেছেন। এছাড়া বিএনপির বহিষ্কৃতসহ অন্তত ১০ জন জয়ের মুখ দেখেছেন।
ভোট নিয়ে আগ্রহ কমছেই
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে গত ৮ মে ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশ, এরপর ২১মে দ্বিতীয় ধাপে ৩৮ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে।
এর আগে ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গড়ে ৩৯.৭১ শতাংশ ভোট পড়ে। ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬০.৯৩ শতাংশ এবং তৃতীয় উপজেলা ভোটে ২০০৯ সালে ৬৭.৬৯ শতাংশ ভোট পড়ে।
এই হিসেবে গত দেড় দশকের মধ্যে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে কম ভোটের হার দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যে ধারাবাহিকভাবেই কমে আসছে তা মানছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।
তার কথায়, “উপকূলীয় এলাকাসহ ঢাকা ও অনেক জায়গায় ঘূর্ণিঝড় রেমেলের প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় না, এর প্রভাবে ভোটার উপস্থিতি কমবে। ইতোমধ্যে দুর্যোগের আঁচ কমে গেছে।
“ভোটার উপস্থিতি কোনো কারণে কমছে; এটা সবারই ভেবে দেখা উচিত-কেন কেন্দ্র বিমুখ হচ্ছে ভোটাররা। ভোট দিতে আসছে না কেন, এটা খোঁজা উচিত। ভোটাররা হয়তো আস্থা পাচ্ছে না।”
ভোটারদের আস্থাহীনতার জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে ভোট বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার।
“সামনের নির্বাচনগুলোয় খুব বেশি ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলা যায় না। একটা বড় দল ও সমমনা দল আসেনি ভোটে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও বহিষ্কার করা হচ্ছে, আর ভোটের বিষয়ে নেগেটিভ প্রচারণা চালাচ্ছে; এটাও ভোটের হার কমার একটা কারণ। আরও বিষয় রয়েছে। ইসির একার পক্ষে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো সম্ভব না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন কবিতা খানম।
তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “আমার কাছে মনে হয়- আগের দুটি ধাপে যেমন হয়েছে, সেরকমই ভোটার উপস্থিতি হতে পারে। সামান্য কম বেশি হলেও খুব বেশি পার্থক্য হবে না। কারণ, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব তো আছেই।
“এর সঙ্গে অন্য কারণ হচ্ছে- প্রকৃতভাবে যদি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়; তখন ভোটাররা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যেহেতু জানে তারা, ভোট হচ্ছে একই দলের ভেতরে। ‘যেই জিতুক, দল থেকে জিতবে; এজন্য আমার ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই’।”
তৃতীয় ধাপের ভোটে নরসিংদীর রায়পুরায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়াকে খুনের যেমন ঘটনা ঘটেছে, তেমনই আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে কয়েক জায়গায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে।
এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বলেন, “তৃতীয় ধাপে এসে ভোটকে কেন্দ্র করে অনেক এলাকায় সহিংসতা বেড়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনও বেড়েছে। এটা ভোটের জন্য অ্যালার্মিং।
“আর ভোটার উপস্থিতি তো ক্রমান্বয়ে কমছে। রেমেলের পর বুধবার ভোটার উপস্থিতি মনে হয় দুই ধাপের চেয়ে কমতে পারে।”
ভোট তথ্য
• ভোটের এলাকা: ৮৭ উপজেলা
• কেন্দ্র: ৭ হাজার ৪৫০টি
• ভোটকক্ষ: ৫৪ হাজার ৮৯টি
• ভোটার: ২ কোটি ৮ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৪ জন
• পুরুষ ভোটার: ১ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার ৩৪৭ জন
• নারী ভোটার: ১ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৭২৩ জন
• হিজড়া ভোটার: ১১৪ জন
• ১৬টি উপজেলায় ইভিএমে ভোট
• বাকি ৭১ উপজেলায় ভোট হবে ব্যালট পেপারে
কমিশনের দায় দেখছেন না ইসি আলমগীর
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে ভোটার উপস্থিতি কমলেও তাতে নির্বাচন কমিশনের দায় দেখছেন না নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।
তার ভাষ্যে, “ভোটার উপস্থিতি কমিশনের উপরে ডিপেন্ডেন্ট না। ইসির উপর ডিপেন্ডেন্ট- কমিশন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পেরেছে কি না, ভোটার-প্রার্থীর নিরাপত্তা রয়েছে কি না-সেটাতে কোনো সমস্যা নেই। অতএব নির্বাচন কমিশনের কারণে কোনো ভোটার উপস্থিতি কমছে না।”
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেন, “ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও সব দল অংশ নেওয়ার পরও ভারতে ৬০ পার্সেন্টের উপরে ভোটাররা ভোট দিচ্ছে না। তার মানে ৪০ পার্সেন্ট ভোটার সম্পূর্ণ পরিবেশ ভালো থাকার পরও আসছে না। কেন আসছে না, তা গবেষণার বিষয়।
“বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিও প্রায় কাছাকাছি, একই। সেখানে একটা বড় রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না, তার একটা প্রভাব রয়েছে। এছাড়া আবহাওয়া, সিজন, প্রার্থী কেমন, জনপ্রিয় হলে বেশি ভোট পড়ে। (ভোটার উপস্থিতি) একক বিষয়ের উপর নির্ভর করে না, নানা কারণ রয়েছে।”
ইসি জানিয়েছে, নির্বাচনি এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ থেকে ১৯ জন সদস্য মোতায়েন আছেন। বিশেষ এলাকায় (পার্বত্য ও দুর্গম এলাকা) সাধারণ কেন্দ্রে ১৯ জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ থেকে ২১ জন সদস্য থাকছেন।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর মঙ্গলবার বলেন, “আইনশৃঙ্খলার কোনো সমস্যা নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়।”
আবহাওয়া কেমন থাকে, তার ওপর ‘অনেক কিছু’ নির্ভর করছে বলে মনে করেন তিনি।
তার কথায়, “ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে এটা তো এখন বলতে পারছি না। ভোটের দিনই জানা যাবে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভোটের হারে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা বলা কঠিন। কোথায় কতটুকু ইফেক্ট হয়েছে বা ভোটের দিন ভোট দিতে যেতে কোনো সমস্যা হবে কি না- এর উপ নির্ভর করবে। আগাম বলা যাবে না।”
# রেমালে ভোট স্থগিত হওয়া ২২ উপজেলা হচ্ছে - শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, পটুয়াখালী সদর, মির্জাগঞ্জ, দুমকী, মঠবাড়িয়া, তজুমদ্দিন, লালমোহন, রাজাপুর, কাঠালিয়া, বামনা, পাথরঘাটা, বাঘাইছড়ি, কচুয়া, ফরিদগঞ্জ ও খালিয়াজুরী।
# এ ধাপে চেয়ারম্যান পদে একজন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন; অর্থাৎ মোট ১২ জন প্রার্থী ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
দেশের মোট ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫ উপজেলায় চার ধাপে ভোট হচ্ছে এবার। প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় এবং দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ভোট হয়েছে। তৃতীয় ধাপে ৮৭ উপজেলায় ভোট হচ্ছে বুধবার। এরপর ৫ জুন চতুর্থ ধাপের ভোট রয়েছে।
প্রথম তিন ধাপেই বেশ কিছু উপজেলায় ভোট স্থগিত হচ্ছে, সেসব উপজেলার ভোটগ্রহণ চতুর্থ ধাপের সঙ্গে হবে নাকি চার ধাপের নির্বাচন শেষে হবে, তা স্পষ্ট করেননি নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।
তিনি বলেন, “নতুন তারিখ এখনও ঠিক করা হয়নি। আবহাওয়া কেমন থাকে, স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে, সামনে ঈদ রয়েছে এবং চতর্থ ধাপের ভোট রয়েছে ৫ জুন। সব বিবেচনা করে চতুর্থ ধাপে কোনটা করা যায় কিংবা পরে কবে করা যায় তা জানানো হবে।”
আরও পড়ুন:
রেমাল: আরও ৩ উপজেলায় ভোট স্থগিত
তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোট ২৯ মে
উপজেলা নির্বাচন: প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৩৬.১%
স্থানীয় নির্বাচনেও কেন ভোটের হারে ভাটা?
উপজেলা চেয়ারম্যান: লড়াইয়ে নারী মাত্র ৪%, 'প্রতিবন্ধকতা' পদে পদে