“বাবা মা-ভাইসহ এ বয়সে একটা ভাঙা ঘরে থাকি। বৃষ্টি বাদলের দিনে খুব কষ্ট হয়। একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে খুব উপকার হত।”
Published : 24 Aug 2023, 11:08 AM
শারীরিক প্রতিবন্ধিতায় পা দুটো একেবারে ছোট আকৃতির, হাত দুটোও ছোট। এক পা বাঁকা হওয়ায় কোনো রকমে আরেক পায়ে ভর করে চলতে হয়। অভাবের সংসারেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সহ্য করতে হয় সমাজের নানান উপহাস ও তাচ্ছিল্য।
তবে এসব বাধা দমিয়ে রাখতে পারেনি কুড়িগ্রামের ফুলতি রানীকে (২০)। অদম্য স্পৃহায় মাত্র ৩২ ইঞ্চি উচ্চতার ফুলতি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আরও পড়াশোনা শেষে তিনি শিক্ষক হয়ে মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চান।
ফুলতির বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের শোভনদহ গ্রামে। ওই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মহেশ চন্দ্র ও পারুল বালা দম্পতির মেয়ে।
বাবা মহেশও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। সংসারে উপার্জন করার মত আর কেউ না থাকায় অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান তার মা পারুল।
ভোগডাঙা মডেল কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্রী ফুলতি এবার এইচএসসিতে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে। তার ছোট ভাই পড়ে দশম শ্রেণিতে।
পড়াশোনায় ফুলতির প্রচুর আগ্রহের কারণে তীব্র অভাব-অনটনের মধ্যেও পড়াশোনা করাতে পিছপা হয় নাই মা পারুল। ২০২১ সালের এসএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিএ ২.৭১ পেয়ে উত্তীর্ণ ফুলতি এ বছর চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশা করছে।
সব বাধা ডিঙ্গিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়তে চায় ফুলতিরানী। তার ইচ্ছে বোঝা না হয়ে শিক্ষক হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার, সংসারের হাল ধরার।
ফুলতি রানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “আমি প্রতিবন্ধী হলেও এটা আমার কখনও মনে হয় না। তবে সংসারের অভাব অনটন আমার ইচ্ছেকে ভীষণ আহত করে।”
অদম্য এই শিক্ষার্থী বলেন, “আমি পড়াশোনা শেষ করে একজন শিক্ষক হতে চাই। জ্ঞানের আলো সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে চাই প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা না।”
তিনি আরও বলেন, “বাবা মা-ভাইসহ এ বয়সে একটা ভাঙা ঘরে থাকি। বৃষ্টি বাদলের দিনে আমাদের খুব কষ্ট হয়। একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে পারলে খুব উপকার হত।”
ফুলতির মা পারুল বালা বলেন, “অনেক মানুষ বলে- প্রতিবন্ধী মেয়েকে কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়ে কি লাভ। চাকরি করতে পারবে না, বিয়ে দিতেও পারবে না। আমার তখন কান্না আসে। মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাই বলে তো ফেলে দিতে পারি না। মেয়ের যতদূর ইচ্ছে পড়াশোনা করার আমার কষ্ট হলেও তাকে পড়াবো।”
তিনি আরও বলেন, “আমার খুব অভাবের সংসার। নাই থাকার ঘর। সরকারের কাছে একটা আবেদন- যদি মেয়েটার জন্য একটা থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়, খুবই উপকার হতো। আর পড়াশোনা শেষে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করলে উপকৃত হব, কৃতজ্ঞ থাকব।”
ফুলতির সহপাঠী সামিয়া রহমান বলেন, “ফুলতিরানী খুবই হাস্যোজ্জল। সংসারে অভাব থাকলেও সে কাউকে বুঝতে দেয় না। আমরা ওকে আমাদের সহপাঠী ভাবি, কখনো অন্য চোখে দেখি না।”
প্রতিবেশী রবিদাশ বলেন, “ফুলতির বাবা থেকেও নেই। সংসারের সকল বোঝা ওর মা পারুলের ওপর। খুব কষ্ট করে মেয়েটাকে পড়াচ্ছে। মেট্রিক পাশ করে এখন আইয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে।”
পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বিত্তবান বা সরকার ফুলতি রানীকে সহযোগিতা করলে পরিবারটির অনেক উপকার হতো বলে জানান রবিদাশ।
ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মালেক বলেন, “ফুলতিরানীর জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সরকারি কোনো সহযোগিতার ব্যবস্থা হলে তাকে সহযোগিতা করা হবে।”
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, “আমার কলেজের এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে ফুলতি রানী পরীক্ষা দিচ্ছে। শুনেছি তাদের সংসারের অবস্থা মোটেই ভালো না। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তার পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছেন।
“আমি ফুলতিরানীর জন্য দোয়া করি সে যেন এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারে। এছাড়া ফুলতি রানীকে উচ্চ শিক্ষায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বিত্তবান ও সরকারি সহযোগিতা করা উচিত।”