পাহাড়ে বন উজাড়, সঙ্কটে পানির উৎস

গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ২০১৫ সালে মোরশেদ আলম চৌধুরী স্থানীয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দেন। যদিও ২০২২ সালে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2024, 05:59 PM
Updated : 21 March 2024, 05:59 PM

গোটা একটা ঝিরিতেই কাটা গাছের স্তুপ। প্রতিটি লম্বায় হবে ২০ থেকে ৩০ ফুট; প্রস্থে দুই ফুটের মতো। গাছের গোড়ায় ছিদ্র করা। হাতি দিয়ে টানার জন্য এই ছিদ্রটি করা হয়েছে। আর গাছের মধ্যে রয়েছে ছাতিম, কড়ই, জারুল, গামারি, চাপালিশ, বান্দরহোলা, বহেরা।

এই ঝিরিটার উৎস লেমুপালং খাল। সেখানে গিয়েও দেখা যায়, সেখানেও একই অবস্থা। গোটা খালজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। কেটে কেটে খালে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার শীলঝিরি ও লেমুপালং খালপাড়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ, এভাবেই প্রতিদিন উজাড় হচ্ছে তাদের বনভূমি। তার সঙ্গে হুমকির মুখে পড়ছে দুর্গম পাহাড়ির এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন ঝিরি ও খালগুলো।     

পাড়াবাসী বলছিলেন, প্রভাবশালীরা অবাধে তিন দশক ধরে এভাবে পাহাড়কে বনভূমি শূন্য করে ফলেছে। গাছ কাটা হচ্ছে প্রাকৃতিক বন থেকে; যেগুলো যুগের পর যুগ ধরে পাড়াবাসী সংরক্ষণ করেছে। পাহাড়িরাও এখান থেকে কোনো গাছ কাটে না।

সেই কাটা গাছগুলো ঝিরি ও খালে ফেলার কারণে সেগুলোর পানি দূষিত হচ্ছে। অনেক স্থানে কাঠ টানার জন্য ঝিরির উপর দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। হাতি দিয়ে গাছ টানা হচ্ছে। এর ফলে হাতিও ঝিরির পানি নষ্ট করছে।

দুর্গম পাড়াগুলো গড়েই উঠেছে পানির উৎসের ঝিরি ও খালগুলোকে কেন্দ্র করে। কারণ, অনেক গাছ পানি ধরে রাখে। এই ঝিরিই পাহাড়িদের পানির অন্যতম উৎস।

পাড়াবাসীর অভিযোগ, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার মোরশেদ আলম চৌধুরীর লোকজন এসব গাছ কাটছে। তার ভাই খোরশেদ আলম চৌধুরী লোহাগাড় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

এভাবে গাছ কাটার প্রতিবাদ করায় ২০১৫ সালে মোরশেদ আলম চৌধুরী স্থানীয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দেন। যদিও ২০২২ সালে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এর বাইরে ভয়-ভীতি প্রদর্শন আর হুমকি-ধামকি তো আছেই। এখানে বাইরে থেকে অন্য কোনো ব্যবসায়ী আসতে পারেন না। ফলে ব্যক্তিগত গাছও বাধ্য হয়েই মোরশেদ আলম চৌধুরীর কাছেই বিক্রি করতে হয়। ভয়ে কেউ কিছু বলেন না বলে জানান নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারা।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেছেন, তিনি আইন অনুযায়ী, অনুমতি নিয়েই ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ কাটছেন। কোনো প্রাকৃতিক বা পাড়াবন থেকে গাছ কাটছেন না। অন্য অবৈধ ব্যবসায়ীরা এটা করছেন।

লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের কেয়াজু বাজার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মেরাইত্যা বাজার। সেখানে থেকে উঁচু-নিচু পাহাড় বেয়ে দেড় ঘণ্টার মতো পায়ে হাঁটার পথ লেমুপালং খাল। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমেও বেশ প্রবাহমান একটি খাল। কোনো কোনো অংশে রয়েছে পাথরও।

খালের উভয়পাশে প্রাকৃতিক গাছ-গাছালি রয়েছে। তবে অধিকাংশ বড় বড় গাছ কাটা পড়েছে। কেটে কেটে খাল ও ঝিরিতেই স্তুপ করে রাখা হয়েছে। গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝিরির উপর তৈরি করা হয়েছে গাড়ি চলাচলের রাস্তাও।

শীলঝিরি এলাকায় কাটা গাছ দেখিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলছিলেন, “কেটে নিয়ে যাওয়ার গাছগুলো মধ্যে ঔষধি গাছও রয়েছে। রয়েছে ঝিরি কিংবা খালে পানি ধরে রাখার গাছও। এসব গাছগুলো একেকটি পানির আধার।

“সেসব গাছ না থাকলে একসময় খাল ও ঝিরি শুকিয়ে যাবে। পানির সংকট ভুগতে হবে তাদের। ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম ও এসব প্রাকৃতিক গাছ মিলে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক বন। ঘরের প্রয়োজনেও মৌজার কোনো বাসিন্দাও এসব গাছ কাটেনি কখনও।”

লেমুপালং মৌজার লাংকি পাড়ার বাসিন্দা মেনচং ম্রো জানান, “গাছগুলো মোরশেদ কোম্পানির লোকজন দুমাস আগেই কেটে রেখেছে। কাটার পর বনের বিভিন্ন প্রাকৃতিক গাছ এভাবে ঝিরিতে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। গাছগুলো বড় হওয়ায় কাটার পর হাতি দিয়ে টানা হয়েছে।

“পরে গাড়ি করে নিয়ে যাবে। লেমুপালং খালে এখন যেভাবে পানি দেখা যায়। ভবিষ্যতে এরকম আর থাকবে না। শুকিয়ে যাবে। তখন নিচের কয়েকটি পাড়া পানির সংকটে পড়বে”, বলেন মেনচং ম্রো।

প্রেননয় ম্রো নামে আরেক বাসিন্দা জানান, এই খালের পানি আগে পরিষ্কার ছিল। গাছ কাটার পর ময়লা ও ঘোলা হয়ে গেছে। মোরশেদ কোম্পানির লোকজনকে গাছ না কাটার জন্য বারবার নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও জোর করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। গাছ টানার জন্য হাতিও ব্যবহার করেছে। হাতি কলা বাগানও ধ্বংস করেছে। ক্ষতিপূরণ চেয়েও পাওয়া যায় না।

লেমুংপালং খালের নিচে তিনটি ম্রো পাড়া রয়েছে। ১৭টি পরিবার নিয়ে দেওয়ান পাড়া, ১২টি পরিবার নিয়ে আমতলি পাড়া এবং ১১টি পরিবার নিয়ে বাক্কা পাড়া।

ঝিরিতে ফেলে রাখা একটা বড় গাছ দেখিয়ে সিংরাও নামে এক ম্রো জানান, গাছটি মূলত ঔষধি। এটি বড় হতে প্রায় ৪০ বছর সময় লাগে। গ্যাস্ট্রিক ও কাশি হলে এই গাছের চামড়া খেলে ভাল হয়। গাছের চামড়া কেটে নেওয়ার পর শুকাতে হয়। এরপর শুকানো চামড়া ঘষে পানি দিয়ে মিশিয়ে খেতে হয়। এরকম কত গাছ ৩০ বছর ধরে কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

লেমুপালং খালের উৎসের দিকে যেতে যেতে দেখা যায়, কিছু গাছ একেবারে সদ্য কাটা। হয়ত সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে শ্রমিকরা সটকে পড়েছেন। পথে পথে হাতির বিষ্টাও দেখা গেছে।

খালের পাশে এক জায়গায় শ্রমিকদের থাকার টংঘর রয়েছে। ৮-১০ শ্রমিক থাকার মতো টংঘর। সেখানে কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। টংঘরের উঠানে দেখা গেছে হাতি বেঁধে রাখার শেকলও।

ঝিরিতে জমির, আনিস ও হাশিম নামে তিনজন শ্রমিককে পাওয়া গেল। সবার হাতে গাছ কাটার বড় দা। তবে তারা ঠিকমতো বাংলা বলতে পারেন না। গাছ কাটার জন্য আলীকদম থেকে এসেছেন জানালেও তিনজনের কেউই ঠিকঠাক মতো ঠিকানা বলতে পারেননি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও পাহাড়িদের ধারণা, তারা রোহিঙ্গা।

তাদের মধ্যে হাশিম নামে এক শ্রমিক জানান, তারা মোট চারজন; মোরশেদ কোম্পানির লোক। ১৫ দিন আগে বনের কাঠ কাটার কথা বলে তাদেরকে আলীকদম থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদেরকে মূলত কাঠ কাটতে দেওয়া হয়। মজুরি হিসেবে দৈনিক ৭০০ টাকা করে দেওয়া হয়।

গাছ কাটা ও হাতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। তাদের লেমুপালং খালের অন্য একটি অংশ থেকে কাঠ কাটতে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে মৌজার হেডম্যানকে দায়ী করে সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মেনওয়াই ম্রো বলেন, “এত অভিযোগ দেওয়ার পরও প্রাকৃতিক বনের গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হেডম্যান কোনো সময় জোরালো প্রতিবাদ করেনি। কয়েক বছর আগেও গাছ কাটা নিয়ে সরইয়ে আওয়ামী লীগের অফিসে একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানেও মৌজার হেডম্যানকে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। হেডম্যান যখন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না পাড়াবাসীরা আর কী করবে?”

লেমুপালং মৌজার হেডম্যান কাইনওয়াই ম্রো বলেন, “মোরশেদ কোম্পানিকে বেশ কয়েকবার নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো নিষেধ মানেন না তিনি। উল্টো হুমকি-ধামকি দেয়। গাছ কাটার প্রসঙ্গ আসলে সবসময় আমার বাবার সঙ্গে একটা চুক্তির কথা বলে। কিন্তু কিসের চুক্তি, কার করা চুক্তি কিছুই আমি জানতে পারি না।

যোগাযোগ করা হলে মোরশেদ আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি প্রাকৃতিক বনের গাছ কাটছেন না। তার বৈধ জোট পারমিট (ব্যক্তিগত বাগান কিনে গাছ কাটার জন্য জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগ থেকে দেওয়া অনুমতিপত্র) রয়েছে। কিছু ‘অবৈধ গাছ’ ব্যবসায়ী একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক বনের গাছ কাটার মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে।

তিনি বলেন, লেমুপালং খালে ও ঝিরিতে যেসব প্রাকৃতিক বনের গাছ রয়েছে সেগুলো তার নয়। অন্য কোনো ব্যবসায়ীর হতে পারে।

ওই এলাকায় কারা অবৈধ গাছ ব্যবসায়ী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা যখন আমার নাম নাম খুঁজে বের করেছেন। তাহলে সেখানে অবৈধ গাছ ব্যবসায়ী কারা রয়েছে খুঁজলে সেটাও বের হয়ে আসবে।

ঝিরির উপর বাঁধ বা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে জানতে চাইলে মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, “ব্যক্তিগত বাগান কেনা গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে।”

এ বিষয়ে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরিফুল হক বেলাল বলেন, “লেমুপালং মৌজায় বনবিভাগের এখতিয়ারভুক্ত সংরক্ষিত কোনো বন নেই। এটা পাহাড়ি এলাকা হিসেবে আগে থেকেই প্রাকৃতিক বন। যেটাকে বনবিভাগ খাস ভূমি বলে থাকে। এসব এলাকায় পাড়াবন বা মৌজাবন হিসেবেও কিছু থাকে। সংশ্লিষ্ট মৌজাপ্রধান হেডম্যান বা কারবারি এগুলো ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। সেখানে বনবিভাগের কোনো অথরিটি নেই।

“কারণ হচ্ছে, আমাদের রিজার্ভ বন যেটুকু আছে, যেখানে আমরা বাগান করি, সেটুকু আমরা সুরক্ষা করে থাকি। তবে সেসব এলাকা থেকে যখন অবৈধভাবে গাছ পরিবহন হয় সেক্ষেত্রে বনবিভাগ অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে।”

তিনি জানান, এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রেঞ্জ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা উদ্ধার অভিযানে যাবে। আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ কমিটির বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়াম আমলাই জানান, “অবৈধ গাছ কাটা বন্ধ করার জন্য খুব বেশি শক্তি প্রয়োগ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এগুলো বনবিভাগ একাই পারে। বনবিভাগ বৈধতা দিচ্ছে বলে গাছগুলো চলে যাচ্ছে।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, “এ ঘটনায় নওশাদ ও খোরশেদ দুইজনের নামে মামলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও অনেক মামলা আছে। সিলেটের এক লোকও হাতি পালে শুনেছি। কিন্তু জায়গাটা এমন দুর্গম এলায়কায়, আমি নিজেও সোমবার সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু জায়গার-গোড়ায় পৌঁছতে পারিনি।

“গাড়ি থেকে নেমে অনেকক্ষণও হাঁটতে হয়েছিল। সোমবার ঘটনাস্থলে বিট অফিসারকে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। হাতির মালিক ও তাদের বিরুদ্ধে রেগুলার মামলাও হবে। আগেও অনেক মামলা আছে। এখন মামলাগুলো মুভ করা হবে।”

বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, “মোরশেদ আলম চৌধুরী জোট পারমিটের কথা বললেও তিনি সেটি দেখিয়েছেন কিনা জানা নেই। জোট পারমিটের কাগজ দেখালে আমরা সেটি ভেরিফাই করে দেখব। কারণ জোট পারমিট তো যে কেউ পেতে পারে।

“সেখানে এরই মধ্যে লামা ইউএনও ভিজিট করেছেন। টাস্কফোর্সের অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। সেখানে কারও একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব না। যেহেতু বন এলাকা, বনবিভাগসহ সবাইকে নিয়ে টাস্কফোর্সের অভিযানের কথা বলেছি। বনবিভাগে তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। সেটি আরও ত্বরান্বিত করতেও বলা হয়েছে।”