না জানিয়ে গাছ কাটার এ কাজে খুশি নয় খোদ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনও।
Published : 25 Feb 2024, 09:55 PM
নারায়ণগঞ্জ শহরে শীতলক্ষ্যা পাড়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের অর্ধশতাধিক গাছ কেটেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।
নির্বিচারে গাছ কাটায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
বিআইডব্লিউটিএ বলছে, এই স্থানে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। যেখানে থাকবে আধুনিক রেস্ট হাউস, পার্কিং প্লেস।
গত বছরের নভেম্বরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জে তিনটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন প্রকল্পের একটি এটি। এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে।
যদিও আন্দোলনকারীরা পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএর প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩ নম্বর মাছঘাট এলাকায় নদীর তীরে গাছ কেটে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এই প্রতিবেদক সেই গাছগুলোর অন্তত ৩২টি গুড়ি খুঁজে পেয়েছেন, যা সম্প্রতি কাটা হয়েছে। চারপাশ বাঁধানো একটি পুরোনো বটগাছের ডালপালা ও গোড়ার কিছু অংশও কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, ইতোমধ্যে দশক পুরোনো কড়ই, বটগাছসহ অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
৩ নম্বর মাছঘাটে বসে সবজি বিক্রি করেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা শাহানুর বেগম।
গত শনিবার দুপুরে তাকে প্ল্যাস্টিকের একটি বস্তা দিয়ে মাথা ঢেকে বসতে দেখা যায়।
রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচতে এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান এই নারী।
কেননা, এতদিন যে কড়ই গাছটি তাকে ছায়া দিত সেটি কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে, আশপাশের কয়েক দশক বয়সি আরও অর্ধশতাধিক গাছ।
কেটে ফেলা গাছের গোড়াটি দেখিয়ে এই নারী বলেন, “আমি কয়েক বছর ধরে এইহানে বসে সবজি বিক্রি করছি। রইদ বা হাল্কা বৃষ্টিতে এই গাছ আমারে আরাম দিত। এহন চাইরদিকে ছায়ার মতন কিছু নাই। শুনছি, সরকারি কর্মকর্তারা বিল্ডিং করব এইহানে, তাই গাছ কাটছে। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কথা কি কেউ ভাবে?”
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুসারে, শীতলক্ষ্যা নদীর চারপাশের এলাকাসহ দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব এলাকাতে প্রাকৃতিক বন ও গাছ কাটা বা আহরণ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কার্যকলাপসহ আইনে নয়টি কার্যক্রম সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আইনের বিষয়টি উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সমন্বয়কারী ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘প্রতিবেশ আন্দোলন’এর সদস্য তরিকুল সুজন বলেন, “ইসিএ তালিকায় শীতলক্ষ্যা নদী রয়েছে ১২ নম্বরে। বিআইডব্লিউটিএ নির্মাণের জন্য এই নদীর তীরের শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।
“আমরা বিশ্বাস করি, এই গাছগুলো রেখেই অবকাঠামো তৈরি করা যায়। শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশেও এমন উদাহরণ রয়েছে। গাছ কেটে আমরা কোনো স্থাপনা হতে দেব না। তারা যদি গাছ কেটে এটি নির্মাণ করতে চায় এবং তাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে দায়ভার বিআইডব্লিউটিএকেই নিতে হবে।”
এদিকে, রোববার দুপুরে গাছ কাটায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জ মহানগর অংশ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। আইন অনুসারে এই এলাকার প্রাকৃতিক গাছপালা কাটা কিংবা আহরণ এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সব কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অথচ বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় তাদের স্থাপনা ও গাড়ি পার্কিংয়ের স্থাপনা নির্মাণের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর তিন নম্বর মাছঘাট এলাকার শতাধিক গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলেছে।
এছাড়াও তারা মাছঘাটের প্রাচীন বটগাছটিও কাটার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে বটগাছটির প্রায় সব ডাল ও কাণ্ডের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, এতে ওই এলাকার পাখপাখালি, পোকামাকড়সহ গাছগুলোর ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য প্রাণ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
পাশাপাশি প্রাচীন বটগাছটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শহরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেশের নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর এমন কর্মকাণ্ডে নারায়ণগঞ্জবাসী গভীর উদ্বিগ্ন বলেও স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়।
গাছ কাটার এই কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’আখ্যা দিয়ে ‘শীতলক্ষ্যা পাড়ের গাছ রক্ষায় নারায়ণগঞ্জবাসী’ আন্দোলনের সমন্বয়ক কবি আরিফ বুলবুল বলেন, “নদীর তীরে নিরিবিলি জায়গা হওয়ায় এটি ছিল সংস্কৃতিমনা মানুষের মিলনমেলা। শুধু মানুষের নয়, গাছগুলো পাখি এবং বিভিন্ন প্রজাতির বাসস্থানও ছিল।”
এমন একটি ছায়া-সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে ইট-পাথরের দালান তৈরিকে অদরকারী কাজ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে না। আমি এটাকে গণহত্যাই বলতে চাই।”
না জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর এই গাছ কাটার কর্মকাণ্ডে খুশি নয় খোদ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনও।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম বলেন, “নগর এলাকায় যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাজের বিষয়ে আমাদের জানায়নি। শীতলক্ষ্যার আশপাশের এলাকা ইসিএ তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা জানতে পেরেছি যে বেশ কিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যা নিশ্চিতভাবে বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করবে। সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।”
অন্যদিকে, এই প্রকল্পটি রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানকেও বাধাগ্রস্ত করবে, কারণ এই এলাকাসহ আশেপাশের এলাকা নিয়ে একটি ‘মাল্টিমডাল হাব’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে রাজউকের, যোগ করেন নাসিকের এই কর্মকর্তা।
যোগাযোগ করা হলে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিন পাঠান বলেন, “নদীর পাড়ে এই এলাকায় একটি টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের কারণে কিছু গাছ কাটতে হয়েছে। গাছগুলো বিআইডব্লিউটিএর জমিতেই ছিল। নিয়ম মেনে আমরা বন বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নিয়ে গাছ কেটেছি।”