প্রার্থীদের অনেকেরই ধারণা, সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশিই ভোট পড়বে ৯ মার্চের সিটি নির্বাচনে।
Published : 27 Feb 2024, 10:15 PM
নেত্রকোণা, শেরপুরের গাড়িগুলো ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে শম্ভুগঞ্জ বাজারের শেষ মাথার তিন রাস্তার মোড় (গোলচত্বর) দিয়ে। মঙ্গলবার দুপুরে বাসে বসেই ভোটের হওয়া বোঝা যাচ্ছিল বেশ।
একসঙ্গে কয়েকটি মাইক থেকে কাউন্সিলর আর মেয়র প্রার্থীদের নামে প্রচারের আওয়াজে কান পাতাই দায়। বাসের যাত্রীরা কৌতূহল নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন, কার কী প্রচার চলছে।
আরেকটু সামনে এগোলেই কিশোরগঞ্জ রোডের তিন রাস্তার মোড়। বাস থেকে সেখানে নেমে যেদিকে চোখ যায় পোস্টার আর পোস্টার। সেই সঙ্গে অটোরিকশায় মাইক লাগিয়ে কানফাটা আওয়াজে প্রচার চলছে।
এই জায়গায় বাস থামিয়ে চালকের সহকারীরা (হেলপার) নেত্রকোণা, শেরপুর আর কিশোরগঞ্জের যাত্রী তোলেন। ভাড়া নিয়ে দরাদরি করেন। কিন্তু মাইকের শব্দে যাত্রী আর হেলপার- সবাই বিরক্ত।
পাশের একটি সিমেন্টের দোকানের সামনে টং দোকানে দাঁড়িয়ে কয়েকজন চা খাচ্ছিলেন। মাথার উপরে আড়াআড়ি ঝুলছিল একজন মেয়র প্রার্থী এবং একজন সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টার।
ভোটের প্রচার কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে মধ্যবয়সী একজন মাইকের দিকে আঙুল তাক করে বললেন, “দেখছেন না, কান পাতা যাচ্ছে না।”
প্রচার দেখে কী মনে হচ্ছে, ভোট কেমন হবে? জবাবে বয়স ত্রিশের আব্দুল মালেক একজন নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টার দেখালেন। বললেন, “নতুন ইলেকশন তো, কেউ বাদ নাই। সবাই দাঁড়াইয়া পড়ছে। বুঝেন এক ওয়ার্ডেই আটজন নারী প্রার্থী।”
ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্রের ওপারে শম্ভুগঞ্জ। আগে এ এলাকা ছিল চরনিলক্ষীয়া ইউনিয়নের মধ্যে। ময়মনসিংহ পৌরসভা সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হওয়ার পর শম্ভুগঞ্জও এর অংশ হয়ে যায়। এটাই সিটি করপোরেশনের শেষ সীমানা; এখানে ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে।
আব্দুল মালেক জানালেন, তার বাসা রেললাইনের পাশের পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের কাছেই। তিনি যে আটজন নারী প্রার্থীর কথা বলছিলেন, তারা আসলে ওই তিনটি ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনের (১১ নম্বর ওয়ার্ড) প্রার্থী। এই তিন ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন ১১ জন।
১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাইরে সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী হয়েছে ১ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে মোট ১০ জন প্রার্থী লড়ছেন।
তিন রাস্তার মোড় থেকে ব্রহ্মপুত্র সেতুর দিকে একটু এগোলেই ইসলাম স’মিল, পাশে পেট্রোল পাম্প। সেখানে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর ক্যাম্পে বসে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, নির্বাচন নিয়ে ভোটাররা বেশ আগ্রহী। প্রার্থীদের কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ব্রহ্মপুত্র সেতুর ডান দিকের রাস্তাটি কালীবাড়ী রোড হয়ে টাউন হলের দিকে চলে গেছে। এসকে হাসপাতাল ও প্রাণিসম্পদ অফিসের পাশের এলাকাটি কবরখানা হিসেবে পরিচিত। এটি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। এখানেই গত মেয়াদের মেয়র ইকরামুল হক টিটুর পৈত্রিক বাড়ি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বেশ প্রাধান্য আছে এখানে। এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর শীতল সরকার। এখানে এবার সাধারণ কাউন্সিলর পদে সর্বোচ্চ নয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন সাবেক কমিশনার। সাতজন হিন্দু সম্প্রদায়ের। মোট ভোটার ৯ হাজার ৪৮ জন।
এসকে হাসপাতালে বিপরীতেই পুরাতন গুদারা ঘাট। সেখানে বেশ কিছু চায়ের দোকান রয়েছে। একটি চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল এক তরুণ আব্দুর রবের সঙ্গে; যিনি নদীর ওপার থেকে প্রতিদিন শহরে কাজ করতে আসেন।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে ভোটের হার ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ। ৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কেমন হতে পারে, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল রবকে।
উত্তরে তিনি বললেন, “এই ওয়ার্ডে নয়জন ক্যান্ডিডেট, নারী ক্যান্ডিডেট আছে চারজন। মোট ১৩ জন প্রার্থী; আর ভোটার নয় হাজার। সবাই তো নিজের ভোটার কেন্দ্রে নিতে চাইব। মানুষ কয়জনরে ‘না’ করব। সবাই তো সবাইরে চিনে। ঠিকই ভোট দিতে যাইব।”
রবের বিশ্বাস, সিটি নির্বাচনের ভোটের হার সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশিই হবে। কারণ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে চাইবে। মেয়র প্রার্থীরাও ভোট পাবেন, কারণ ভোটের মাঠে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন পাঁচজন, তাদের চারজনই আওয়ামী লীগের।
তবে সব ওয়ার্ডের চিত্র এরকম নয় বলে জানালেন ময়মনসিংহ শহরের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী; যিনি প্রায় চার দশক ধরে রাজনীতিতে সক্রিয়।
তিনি বলছিলেন, “নয় নম্বর ওয়ার্ড প্রার্থী আছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এমন অনেক ওয়ার্ড আছে যেখানে অনেকেই প্রার্থী হতে চেয়েও হননি। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ আছে।”
উদাহরণ দিয়ে ওই আইনজীবী বলেন, “এত বড় নির্বাচন কিন্তু ১৬ নম্বর, ১৭ নম্বর, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র দুজন করে কাউন্সিলর ক্যান্ডিডেট। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে তো এক বিএনপি সমর্থক নেতা বিনাভোটেই কাউন্সিলর হইল। এটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।”
শহরের পণ্ডিতপাড়া ও নতুন বাজার এলাকাতেও ভোটের বেশ প্রচার দেখা গেল। সেখানে কথা হয় দুজন প্রাক্তন বাম ছাত্রনেতার সঙ্গে। তারা এখনও রাজনীতিতে সক্রিয়; তবে তাদের দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।
তাদের একজন বললেন, “এই শহরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত, এটা সবাই জানে। শহরের টাউন হল মোড় থেকে স্টেশন রোড সেকেন্ড গেইটের দুই পাশ হচ্ছে ‘পশ এরিয়া’, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই।
“এখানে ফুটপাতে প্রচুর ব্যবসা আছে। নিয়মিত টাকা দিয়ে মানুষকে এখানে ব্যবসা করতে হয়। ফলে ৭ নম্বর, ৮ নম্বর আর ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী বেশি। কারণ, এখানে রাজনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার লড়াই আছে। নেতাদের চোখ এসব এলাকায় বেশি। এখন সানকি পাড়া এলাকায়ও এটা হচ্ছে। ফলে এসব এলাকায় ভালো ভোট পড়বে।”
ভোট নিয়ে যে উত্তেজনা বাড়ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভোটকে কেন্দ্র করে শহর গরম। ১২ দিনে চারটা খুন হয়েছে। এটা উদ্বেগজনক। তারপরও এখানে ভোট পড়বে। সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশি ভোটই পড়বে।”
হাসতে হাসতে পাশ থেকে আরেকজন সাবেক ছাত্রনেতা বলছিলেন, “সরকারের টার্গেট ফুলফিল হবে এখানে।”
সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু একবার কমিশনার ও চারবার কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করেছেন। এবার ষষ্ঠবারের মত তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ড (আকুয়া) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেখেন ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া আছে। আমার ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে যদি বলেন, এখানে সবাই জানপ্রাণ দিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্য চেষ্টা করছেন।”
বিএনপি তো নির্বাচনে আসেনি, সবাই আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগপন্থি- ভোটারদের মধ্যে তো অনীহা থাকতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা জাসদের এই নেতা বলেন, “অন্য ওয়ার্ডের কথা বলতে পারব না। কিন্তু আমার ওয়ার্ডে বিএনপি-আওয়ামী লীগ অর্ধেক অর্ধেক।”
ভোটার কেমন হবে মনে হচ্ছে- এই প্রশ্নে পাঁচবারের এই কাউন্সিলর বলেন, “আমার এখানে ১১ হাজারের মত ভোটার। ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ ভোট কাস্ট হবে এটা লিখে রাখেন। ভোটের পরে বইলেন যে ভাই কী কইছিল।
“এইখানে জাতীয় নির্বাচনের সময় ভোট দিয়ে মানুষ দেখছে, ভোট কথা কইছে। সেই কারণে আস্থা বাড়ছে। আর এটা তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন।”
আব্দুল মান্নান ১৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একবার কমিশনার এবং একবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এবার তিনি তৃতীয়বারের মত কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। এই আওয়ামী লীগ নেতা পেশায় ব্যবসায়ী। ১৯৮৯ সালের দিকে একবার বাকশালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাজনীতি বেশিদিন করেননি।
এই ওয়ার্ডে ‘উৎসবমুখর পরিবেশে’ ভোটের প্রচার চলছে দাবি করে মান্নান বলেন, “আমার ধারণা এখানে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়বে। মেয়র প্রার্থীরা ভোট যাই আনুক, আমরাই তো ভোট কাস্ট করাব।”
শাম্মী আক্তার মিতু ২ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর। এবার তিনি দ্বিতীয়বারের মত বই মার্কায় ভোট করছেন। মঙ্গলবার রাত ৮টার সময়ও দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট চাইছিলেন।
প্রচারের মধ্যেই তার কাছে প্রশ্ন ছিল কেমন ভোট হবে? জবাবে তিনি বলেন, “মানুষ তো ভালো সাড়া দিচ্ছে। আশা করি, সবাই কেন্দ্রে আসবে। আর এবার তো মেয়র পদে ইলেকশন হচ্ছে।
গতবার তো ইলেকশন হয় নাই, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফল হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। কাউন্সিলরদের পাশাপাশি মেয়র প্রার্থীরাও ভোটার আনবেন।
“আমার মনে হয়, এখানে ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ ভোট পড়ে যেতে পারে। শক্ত ইলেকশন হবে।”
২০১৯ সালে এই সিটির প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মো. ইকরামুল হক টিটু।
আওয়ামী লীগ এবার সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে কারণে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দেয়াল ঘড়ি নিয়ে।
তার সঙ্গে মেয়র পদের ভোটের লড়াইয়ে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক), শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কী টজু (হাতি প্রতীক), কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সদস্য কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক) এবং জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল (লাঙ্গল প্রতীক)।
এছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৯ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবারের নির্বাচনে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। ৯ মার্চ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) তাদের ভোটগ্রহণ হবে।