নিজেদের মাঠে টানা তিন ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ শেষ করেছে স্বাগতিক কাতার।
Published : 30 Nov 2022, 08:32 PM
স্রেফ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার গর্বটুকুই সঙ্গী কাতারের! আসলেও তাই। রেকর্ড বইয়ের কয়েকটি পাতায় তাদের নাম উঠেছে বটে, কিন্তু সেখানে প্রাপ্তির গল্প কিঞ্চিৎ, বরং রঙহীনতার ছাপ বড্ড বেশি। টানা তিন হারের ব্যর্থতা নিয়ে যে গ্রুপ পর্ব থেকে ঝরে পড়েছে কাতার।
বিশ্বকাপ নিয়ে যত গল্প শোনা যায়, কাতারের আসরের সঙ্গে তার মিল সামান্য। দোহার রাস্তায় মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী পোষাক টুপি-জোব্বা পরা কাতারিদেই দেখা মেলার ভার। যেন ঘরবন্দী তারা। লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মতো তারা ফুটবলপাগল নয়। ভিন্নদেশি সমর্থকদের দেখা মেলে কেবল ম্যাচের সময়, মেট্রোয়, ফ্যান জোনে কিংবা ফ্ল্যাগ প্লাজায়। দোহার রাস্তায় হৈ-হুল্লোড়ে কাউকে মেতে থাকতে দেখা যায় না। সে উচ্ছ্বাসের ঢেউও হয় না বাঁধনহারা।
কাতারিদের আনন্দ, উন্মাদনা আরও থিতিয়ে গেছে দলের ব্যর্থতায়। বিশ্বকাপের ইতিহাসের রেকর্ড একটি পাতায় তারা দক্ষিণ আফ্রিকার এতদিনের একাকীত্ব ঘুচিয়েছে; দ্বিতীয় আয়োজক দল হিসেবে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে। আরেকটি পাতায় অবশ্য শীর্ষে, এই প্রথম কোনো আয়োজক দল বিদায় নিল গ্রুপ পর্বে টানা তিন ম্যাচ হেরে!
বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পাওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশটি বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের সামর্থ্য। ঢাউস আটটি স্টেডিয়াম, সমর্থকদের যাতায়াতের জন্য অত্যাধুনিক মেট্রো ট্রেনের সুবিধা, ব্যয়সাপেক্ষ হলেও দোহায় আবাসন ব্যবস্থা, সবই করল তারা। কেবল পারল না মাঠের ফুটবল দিয়ে বিশ্বের মন জয় করতে।
২০ নভেম্বর আল বায়াত স্টেডিয়ামে একুয়েডরের কাছে ২-০ গোলে হেরে পথচলা শুরু কাতারের। এই ম্যাচের আগে একুয়েডরকে অর্থকড়ি দিয়ে ‘কিনে নেওয়ার’ গুঞ্জন ডানা মেলেছিল প্রবলভাবে, কিন্তু সে গুঞ্জনের সঙ্গে ম্যাচের ফলের হিসেব মেলেনি। ওই উদ্বোধনী দিনেই কাতারিদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা এবং দলের হারে ফের যেন ঘরবন্দী হয়ে যাওয়াও।
এরপর সেনেগালের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারে কাতার। দুই গোল হজমের পর ৭৮তম মিনিটে মোহাম্মদ মুনতেরির গোলে জেগে ওঠার আভাস দেয় কাতারিরা, কিন্তু তা আর সত্যি হয়নি। গ্রুপ পর্ব থেকে দেশটির ছিটকে যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায় ওই হারে।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটি ছিল শেষ ভালোর শেষ সুযোগ। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে নেদারল্যান্ডস, ২০১০ বিশ্বকাপের রানার্সআপ। সেরা সাফল্য যদিও ডাচদের পাওয়া হয়নি আজও, কিন্তু বৈশ্বিক ফুটবলে তাদের সঙ্গে কাতারের ব্যবধান যোজন যোজন মাইল। তা ঘোচাতে পারেননি হোমাম-ইসমাইলরা। তাই বিশ্বকাপের শেষটাও হাসি দিয়ে হয়নি কাতারের। ৩ ম্যাচে ৭ গোল হজমের বিপরীতে ১টি দিয়ে, পয়েন্টের খাতা শুন্য রেখে ছিটকে গেছে তারা।
অথচ বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পাওয়া, ২০১৯ সালের এশিয়ান কাপ জয় এবং এবারের আসরের বাছাইপর্ব অজেয় থেকে শেষ করা। আয়োজক হিসেবে সরাসরি খেলার সুযোগ থাকলেও নিজেদের শাণিয়ে নিতে এশিয়া অঞ্চলের বাছাই অংশ নেয় দলটি। ৮ ম্যাচে সাত জয় ও এক ড্রয়ে অপরাজিত ছিল তারা। কিন্তু বাছাই পর্বের পারফরম্যান্সের রেশ কাতার টেনে নিতে পারল আসল লড়াইয়ে।
গ্যালারির লড়াইয়েও জিততে পারেনি কাতার। আল বায়াত, কিংবা আল থুমামায় কাতারিদের উপস্থিতি থাকে, কিন্তু তা স্রোতস্বীনি নয়। তাদের উন্মাদনাও বাঁধনহারা নয়। তাদের উল্লাসের সাম্বা-ট্যাঙ্গোর নৃত্য নেই। ছেলে-মেয়ের সার্বজনীন অংশগ্রহণ নেই। ঠুংরি, করতাল আর তরবারি উঁচিয়ে প্রথাগত নাচই উপযাপনের উপলক্ষ। কিন্তু স্টেডিয়ামে তরবারি নিয়ে প্রবেশের অনুমতি নেই বলে কাতারিদের ঐতিহ্যবাহী উৎসবও গ্যালারিতে পায় না পূর্ণতা।
কাতারের বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পাওয়া নিয়ে জল ঘোলা হয়েছিল অনেক। অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি দেশটির বিরূপ আচরণ, প্রাণহানির ঘটনা, সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। প্রানহানির কিছু ঘটনা এর মধ্যে তারা স্বীকারও করে নিয়েছে। কাতারিদের সুযোগ ছিল মাঠের ফুটবল দিয়ে কিছুটা সমীহ আদায় করে নেওয়ার, সেটাও পারেনি তারা।
এবারই প্রথম বিশ্বকাপের মরুভূমিতে আসা। এশিয়ান দলগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দলগুলো কেমন করে, তা নিয়েও বাকি বিশ্বের আগ্রহ ছিল বেশ। দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে সৌদি আরব বাকিদের পথও দেখিয়ে দিয়েছিল। ইরান দিশেহারা, কাতারেরও একই দশা। সৌদি আরব ছাড়া এশিয়ার ছয় দলের মধ্যে উত্তর কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান আছে নকআউট পর্বের দৌড়ে।
কাতার বিশ্বকাপ কতটা সফল হলো, তার হিসাব ২০ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনালের পর। আয়োজক হিসেবে হয়ত ‘লেটার মার্কস’ পাবে তারা। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সে কাতার মুরুভূমির হাহাকারের মতোই রিক্ত, রঙহীন।