সাব্বিরের ৫ রান আর একটি শটের ‘ইতিবাচকতা’ ও বাংলাদেশের ক্রিকেট

সাব্বিরের ৫ রানের ইনিংস থেকে পাওয়া যাচ্ছে ইতিবাচক অনেক কিছু, তার একটি শট হয়ে উঠল আলোচনার বিষয়বস্তু। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাস্তবতাও ফুটে উঠছে এসবে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2022, 03:02 PM
Updated : 28 Sept 2022, 03:02 PM

সাব্বির রহমান এই মুহূর্তে নিজেকে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি ভাবতেই পারেন।

সৌভাগ্যের পরশ অবশ্য তিনি মাস দেড়েক আগেই পেয়েছেন, যখন তার জায়গা হলো বাংলাদেশের এশিয়া কাপ দলে। সাড়ে তিন বছরের পর তিনি দলে ফেরেন। তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার অবশ্যই। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য?

বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য তা ছিল নিজেদের দীনতার একটি প্রকাশ। কারণটা খুব সাধারণ। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর এই দীর্ঘ সময়ে সাব্বির এমন কিছু করেননি, যেটায় আবার দলে ফেরার দাবি জানাতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়েও ছিল না উল্লেখযোগ্য কোনো পারফরম্যান্স। তার পরও তাকে ফেরানো হয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে দিশাহীন দল একটু আলোর রেখা পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় ফিরে গেছে নিভু নিভু তারার কাছে।

এমন সৌভাগ্য কজনের হয়!

দলে ফেরায় অবশ্যই সাব্বিরের নিজের হাত নেই। তিনি জোর করে দলে ঢোকেননি। দেশের ক্রিকেটের গভীরতা এতটাই কম, পাইপলাইনের এমনই সঙ্কটাপন্ন অবস্থা, টি-টোয়েন্টির দাবি মেটানোর মতো ক্রিকেটার খুঁজে হয়রান টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকরা আবার তার দুয়ারে কড়া নেড়েছেন।

তবে তার সৌভাগ্যের পালা শেষ নয় এখানেই। এখন মূল আলোচনা যেটি নিয়ে।

দলে ফেরার পর এখনও পর্যন্ত ৩টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। রান করেছেন ৫, ০ ও ১২। অথচ ‘ইম্প্যাক্ট’, ‘ইন্টেন্ট’, ইতিবাচকতা, এসব আলোচনায় দল সংশ্লিষ্টদের কণ্ঠে এই কদিনে বারবার উঠে এসেছে সাব্বিরের নাম।

তার ৫ রানের ইনিংসটির কথাই ধরা যাক। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটিতে তিনি নামেন ওপেনার হিসেবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার। প্রথম বলেই বাঁহাতি পেসার দিলশান মাদুশাঙ্কাকে চার মারেন তিনি প্যাডল স্কুপ করে।

সাড়ে তিন বছর পর দলে ফিরে প্রথম বলেই এমন শট খেলাটা চমকপ্রদ ও সাহসী, কোনো সন্দেহ নেই। এরপর টানা তিন বল ডট। শেষ পর্যন্ত আউট ৬ বলে ৫ রান করে।

অল্প রানে আউট তিনি হতেই পারেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তার ইনিংসটিই পরে হয়ে উঠল উদাহরণ! টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ থেকে শুরু করে দল সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের কথায় বারবার উঠে এলো সাব্বির কতটা ‘পজিটিভ’ ছিলেন কিংবা তার ‘ইন্টেন্ট’ বা অভিপ্রায় কত ভালো ছিল।

একটি ৫ রানের ইনিংসের মধ্যে এত এত ইতিবাচকতা ক্রিকেট ইতিহাসে একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ। প্রথম ম্যাচে সাব্বির শূন্য রানে আউট হন এমন এক বলে, যেটিতে চার বা ছক্কা হতে পারত অনায়াসেই। দ্বিতীয় ম্যাচেও বিদায় নিতে পারতেন শূন্যতে। বাঁহাতি পেসার সাবির আলির বলে বোল্ড হননি অল্পের জন্য। বল তার ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় বাউন্ডারিতে।

পরে সাবিরের একটি ফ্রি হিটেই ছক্কা মারেন তিনি দারুণ শটে। ব্যস, তার ইনিংস শেষ এর পরপরই। কিন্তু নতুন আলোচনার শুরু। ওই যে একটি শট!

ম্যাচের পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স বলেন, “সাব্বির এবার ফেরার পর এখনও এই পর্যায়ে পায়ের নিচে জমিন খুঁজে পায়নি। তবে একটি শটেই সে দেখিয়েছে, ব্যাট হাতে কী করতে পারে। এটাই আরও বেশি দেখতে চাইব।”

তার ৫ রানের ইনিংস থেকে নানা ইতিবাচকতা খোঁজা হয়। তার একটি শটই হয়ে যায় তার সামর্থ্যের পরিচায়ক, মুগ্ধতায় ডুবে যান ব্যাটিং কোচ।

পরম সৌভাগ্যবান তো তাকেই বলা যায়।

অবশ্যই এসবে সাব্বিরের কিছু করার নেই। তিনি তার মতোই করছেন। এরকম ব্যর্থতা কিংবা সাফল্যও ক্রিকেটেরই অংশ। কিন্তু তাকে নিয়ে যা হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের বাস্তবতাও তাতে আরেকবার ফুটে উঠছে। এমনই দুরাবস্থা যে ৫ রান আর একটি শট থেকে নানা ইতিবাচক উপকরণ বের করা হচ্ছে, আত্মবিশ্বাসের রসদ খোঁজা হচ্ছে, বিশ্বাস ও ভরসার গান শোনাতে হচ্ছে। ডুবতে থাকা কারও খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকার প্রয়াস যেন।

সাব্বির একসময় বাংলাদেশ দলে নিয়মিত ছিলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দারুণ কিছু পারফরম্যান্সও তার আছে। বিশেষ করে তিন নম্বরে তার পরিসংখ্যান এখনও ভালো। এই পজিশনে তার গড় ৩১.৪৭, স্ট্রাইক রেট ১২৮.১৪। একসময় তাকে মনে করা হতো এই সংস্করণের জন্য দেশের সবচেয়ে উপযোগী ক্রিকেটার। হাতে শট অনেক, কবজির জোরও বেশ, সাহসের কমতি ছিল না। ফিল্ডিংয়ে ছিলেন দুর্দান্ত, সঙ্গে টুকটাক বোলিং মিলিয়ে দারুণ এক প্যাকেজ। কিন্তু পরে তিনি ফর্ম হারান, ছন্দ হারিয়ে যায়। একসময় তিন সংস্করণে খেলা ক্রিকেটার বাদ পড়েন সব সংস্করণ থেকেই।

তার পর তাকে এই দফায় দলে নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অনেক। ফেরার পর তিনি পারফর্ম করতে পারলে সেই প্রশ্নগুলো হয়তো আড়ালে চলে যেত। তা হয়নি। উল্টো তার ব্যর্থতা থেকেই সাফল্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।

সময় অবশ্য ফুরিয়ে যায়নি। স্রেফ তিনটি ম্যাচ দিয়েই বিচার করা যায় না। আরও সুযোগ তিনি পেতেই পারেন। তার মধ্যে পুরনো সেই ঝলক ও সামর্থ্য এখনও অবশিষ্ট আছে কিনা, তা দেখার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করা যেতেই পারে। তিনি পারলে দলেরই লাভ। কিন্তু তাই বলে ৫ রানের ইনিংস বা একটি শটকে এতটা মহিমান্বিত করতে হবে!

সাব্বিরকে ঘিরে এই ঘটনাকে বলা যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক টুকরো ছবি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখানে শ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছে, ক্রিকেট সংস্কৃতি নামক ব্যাপারটি পালিয়ে বাঁচছে।